Increase Reset Decrease

কালী

দেবী হলেন কালী

শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী দুর্গার যে দশমহাবিদ্যার কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে তৃতীয় মহাবিদ্যা হলেন দেবী কালী। দেবী দুর্গারই অপর এক রূপ-যাঁকে আমরা আদ্যাশক্তি বলে পূজা করি। কালী মূর্তি আমরা সর্বত্রই প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু এঁদের রূপভেদ আছে । যেমন-মহাকালী, রক্ষাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রটন্তীকালী, গুহ্যকালী, সিদ্ধকালী, দক্ষিণাকালী ও ফলহারিণী কালী প্রভৃতি। কালীকে আমরা উগ্ররূপা রূপে দেখে থাকি। কিন্তু ভদ্রকালী রূপে তাঁর শান্ত ও শোভনসুন্দর রূপকে প্রত্যক্ষ করা যায়। পুরাণেও কালীর শান্ত ও উগ্রমূর্তির কথা পাওয়া যায়। তবে পুরাণে ও তন্ত্রে কালী ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিতা।

কালী দশমহাবিদ্যার এক মহাবিদ্যা হলেও এঁর উত্স সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত। কারণ বিভিন্ন তন্ত্রে, পুরাণে ও অন্যান্য শাস্ত্রে কালীর জন্মবৃত্তান্ত-সম্বন্ধে মতবৈচিত্র্য রয়েছে। কাজেই সব মতবাদ নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ কম। সেজন্য কালীর উত্স সন্ধানে ব্রতী না হয়ে পুরাণ ও তন্ত্রোক্ত কয়েকটা কাহিনীর মধ্যে খুঁজে নেওয়া যাক কালী দেবী দুর্গারই আর এক রূপ।

কালী করালবদনা-ভয়ঙ্করী। কালী যদি ভয়ঙ্করী রূপ ধারণ না-করতেন তাহলে বোধ হয় এতো পূজিতা হতেন না। কারণ তাঁর এই উগ্রমূর্তিতে সবাই ভীত, ত্রস্ত। এমনকি দেবাদিদেব মহাদেব পর্যন্ত এই মূর্তিতে ভয় পেয়ে কালী-ভজনা শুরু করেন। পুরাণে কথিত আছে শিবঘরণী সতী একবার দক্ষযজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার জন্য শিবের কাছে অনুমতি চান। শিব বলেন বিনা আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে যাওয়া অনুচিত এবং এতে অসম্মানিত হতে হবে। কিন্তু দক্ষসুতা সতী নাছোড়বান্দা; বার বার পতি শিবকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন পিত্রালয়ে যাওয়ার জন্য। শিবপত্নী সতীর পীড়াপীড়িতে শান্তিপ্রিয় মহাদেব বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘তুমি তো আমার কথার বাধ্য নও, যা খুশি করো-আমার আজ্ঞার অপেক্ষা কেন?’ কিন্তু সতী প্রকৃতই সতী। পতিদেবের আজ্ঞা ব্যতীত কোনো কাজ করতে নারাজ। আবার পিতৃদেবের আয়োজিত যজ্ঞানুষ্ঠানেও যাওয়াটা জরুরি। এমতাবস্থায় দেবী সতী কি করবেন তখন তিনি স্বরূপ প্রকাশ করলেন-এক ভয়ঙ্কর কালীমূর্তি ধারণ করলেন। শিব সেই ভয়ঙ্করী করালবদনীকে দেখে ভয়ে পালাতে যান। কিন্তু পালাবেন কোথায়! দেখেন চারদিকে সেই উগ্র-কালীমূর্তি পথ আগলে আছে। গত্যন্তর নেই দেখে মহাদেব ভয় পেয়ে করজোড়ে প্রার্থনা করেন-‘কে তুমি করালবদনী শ্যামা! পথ ছাড়ো! কোথায় আমার সতী?’ দেবাদিদেব শঙ্করের শঙ্কিত এই করুণ অবস্থা দেখে দেবী সতীর করুণা জাগলো। দয়াপরবশ হয়ে শিববনিতা বললেন; ‘আমি তো তোমার সতী! আমাকে চিনতে পারছো না? আমি সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারিণী। তোমার প্রিয়া হবার জন্য গৌরবর্ণা হয়েছিলাম। আর দশদিকে যে মহাপ্রলয়কারিণী ভয়ঙ্করী রূপ দেখছো তাও আমারই রূপ।’....
এইভাবে গৌরীই কালীরূপ ধারণ করেছেন-নিজ স্বরূপ প্রকাশ করেছেন, যেখানে দশমহাবিদ্যার এক বিদ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এ যেন লীলাময়ী আদ্যাশক্তির এক লীলাবিলাস। সংহারিণী রূপ ধারণ করার জন্যই যেন এই লীলা। তাই কালীবিলাস তন্ত্রে বলা হয়েছে, গৌরীর দেহ থেকেই কালীর উত্পত্তি। তবে তন্ত্রের এই কালিকা আর পুরাণের কালী এক নয়।

পদ্মপুরাণ অনুসারে, সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ব্রহ্মাই নাকি দেবী গৌরীকে কালো করে দিয়েছেন। গৌরী যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন ব্রহ্মা কালরাত্রি দেবীকে পাঠিয়ে কৃষ্ণবর্ণা করে দেন গৌরীকে। এই কৃষ্ণকায়া করার পিছনেও ছিল একটা উদ্দেশ্য। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ হওয়ার জন্য তাদের অন্তঃকলহ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কৃষ্ণকায়া কন্যাকে বহু সাধ্য-সাধনা করে গৌরবর্ণ হতে হবে। আর এই তপস্যারও বিশেষ প্রয়োজন ছিল, যাতে দেবীর ওজোশক্তি বর্ধিত হবে। ফলে অর্জিত এই তপঃশক্তিতে অসুর-নিধন করাও সম্ভব হবে। এইরকম যুগপৎ উদ্দেশ্য নিয়েই নাকি গৌরীকে কৃষ্ণরূপা অর্থাৎ কালীরূপে সৃষ্টি করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা।

আবার আর এক মতে, পার্বতীর ক্রোধ থেকে নাকি উত্পন্ন কালী। সেজন্য কালী ভয়ঙ্করী ও উগ্রমূর্তিধারিণী। তবে কালী সম্বন্ধে বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন আরো মতামত থাকলেও, দেবী দুর্গারই অপর এক প্রকাশ কালীরূপে। কাজেই সাধক দুর্গাপূজা করুন বা কালী-সাধনা করুন, ফলত এক আদ্যাশক্তিরই আরাধনা করা হবে।

Print