Increase Reset Decrease

দশ মহাবিদ্যা

শিবের দশ মহাবিদ্যা দর্শন

শিবজায়া শিবাণী যখন নারদের মুখে তাঁর পিতা দক্ষের শিবহীন যজ্ঞের কথা শুনলেন, তখনই তাঁর মনে ইচ্ছা জেগেছিল তিনি নিজে অনিমন্ত্রিত হয়েও যাবেন সেখানে-পিতা দক্ষকে বুঝিয়ে দিতে, শিবহীন যজ্ঞের কী ফল? তাই তিনি স্বামীর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছেন পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য। কিন্তু দেবাদিদেব তো জানেন এর ফল কী হবে। তাই তাঁর প্রবল আপত্তি সতীকে দক্ষালয়ে যেতে দিতে। কিন্তু সতী আবার বলছেন তাঁর উদ্দেশ্য-“ত্রিসংসারে তব অপমান, ছার প্রাণ রেখেছি এখনও? সতী নাম কেন দিল মাতা? পতি ভক্তি এই কি আমার? যজ্ঞে যেতে মানা নাহি কর মোরে। যদি তব পদে থাকে মম মতি, দেখবি কেমনে ত্রিসংসার মিলি হরে করে অপমান। আজ্ঞা দেহ যাব দক্ষপুরে।”

তবুও প্রাণেশ্বরী সতীকে যেতে দিতে অনিহা মহাদেবের। কারণ, “আজি ছেড়ে যেতে চাও, কেন পাগলে কাঁদাও? গেলে তুমি আসিবে না আর।” শিব জানেন কী পরিণাম হবে। সতী পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করবেন। তাই ভবিষ্যৎ ভেবে সতীর অদর্শন-বিরহে ব্যাকুল মহাদেবের প্রবল আপত্তি তাঁকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু নিয়তি! স্বয়ং মহমিায়ার ইচ্ছাকে নিবারণ করার সাধ্য কারও নেই।

মহাদেবকে অনেক কাতর অনুনয় প্রার্থনায় যখন সম্মতি পাওয়া গেল না তখন আদ্যাশক্তি মহামায়া তাঁর মায়াশক্তি বিস্তার করে স্বয়ং বিশ্বনাথ, স্বামী মহাদেবকে, তাঁর স্বরূপ জানিয়ে দিলেন-কে তিনি। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই। এই যে জগদম্বা মহামায়া পরমা প্রকৃতির লীলাবিগ্রহের একে একে প্রকাশ দশদিক আলো করে শিবের সামনে, তা-ই দেবী ভগবতীর দশমহাবিদ্যা নামে ভুবনবিদিত।

দেবী নিজেও সবই জানতেন, কেন তিনি যাচ্ছেন, তার ফল কী হবে? তবুও মিথ্যা অভিমান-অহংকারীর শাস্তিদান ও স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধ-ভক্তির মহিমা জগৎকে দেখানোর প্রয়োজনে এই লীলা-বিগ্রহগুলির সৃষ্টি ও তাঁর এক অচিন্ত্যনীয় লীলা। আর জগতের সাধক ভক্তের দল পেল-মা করুণাময়ী ভগবতীর দশটি অপূর্ব লীলাবিগ্রহ। -চামুণ্ডাতন্ত্রে এঁদের নাম বলা হয়েচে “কালী-তারা-মহাবিদ্যা-ষোড়শী ভুবনেশ্বরী। ভৈরবী-ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।। বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী-কমলাত্মিকা। এত দশমহাবিদ্যা নামেও খ্যাতা।

Devi Brahmacharini

শিব যখন দেবীকে অনুমতি না দিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলেন, তখন দেবী সতী প্রথমে কালীরূপ ধরে শিবের ভীতি উৎপাদন করে তাঁর পথরোধ করেন। ভয় পেয়ে অন্য যেদিক দিয়েই পালাতে চাইছিলেন সবদিকেই একে একে এই সব ভিন্ন ভিন্ন দেবীমূর্তির আবির্ভাব শিবকে বিহ্বল করে তোলে। শিব সেই অভিনব দশমূর্তি দেখে দিশাহারা হয়ে ভীত কণ্ঠে বললেন, “তোমরা কারা? আমার সতী কোথায় গেল?” তার উত্তরে এক মূর্তি বললেন, “আমিই তোমার সতী। এই যে ভীষণা দশটি মূর্তি-এরা আমারই বিভিন্ন প্রকাশ। ভয় পেও না।” শিব বললেন “তুমি যদি আমার প্রাণেশ্বরী সতীই হও, তাহলে এমন কৃষ্ণবর্ণা ভীতিপ্রদা কেন?” সতী আবার বললেন, “আমি সতীই; শুধু তোমার চোখ খুলে দেওয়ার জন্যই আমার এই নানা মূর্তির প্রকাশ ঘটিয়েছি। এখন বলছি শোন, আমার এই বিভিন্ন মূর্তির নাম। তোমার সামনে এই দেখ আমি কালীমূর্তিতে, তোমার ঊর্ধ্বদিকে আমি মহাকালীস্বরূপিণী তারিণী তারা। বামদিকে ভুবনেশ্বরী, তোমার পেছনদিকে আমি দানবনাশিনী বগলা মূর্তিতে। অগ্নিকোণে আমি বিধবা জরতী রূপে ধূমাবতী নামে আছি। নৈর্ঋত কোণে আছি সর্ব ঐশ্বর্যের অধিশ্বরী কমলা রূপে। বায়ুকোণে আছি মাতঙ্গী রূপে। ঈশান কোণে আছি সর্ব সৌন্দর্যের অধিশ্বরী ত্রিপুরেশ্বরী ষোড়শী হয়ে। আর তোমার সঙ্গে কথা বলছি যে আমি, সে ভৈরবী-ভৈরবসঙ্গিনী।”

মূলত আমি এক ও অদ্বিতীয়া। প্রয়োজনে আমার এই দশরূপে প্রকাশ হয়। আজ তোমাকে আমার এই লীলাবিগ্রহদের দর্শন করালাম। এবার আমায় দক্ষযজ্ঞস্থলে যাবার অনুমতি দাও।” তখন তিনি সতীর প্রকৃত পরিচয় বুঝতে পারেন-“হায় ফুটিয়া না ফুটে আঁখি মোর, মায়াঘোর কেমনে ছেদিব? মহামায়া আপনি করিছে ছল! সতি, নিষেধ না করি আর, যাও পিত্রালয়ে কিন্তু ভুল না, ভুল না ভাঙ্গড়েরে। তব অদর্শনে খ্যাপা তোর আকুল হইবে। কি কহিব আর, অন্তরের সার তুমি মম। তোমা বিনা শব আমি।।”
এই দশমহাবিদ্যা শিবেরই মানসপ্রতিমা। শিবকে উপলক্ষ্য করে জগতের তাবৎ সন্তানদের সাধনার সিদ্ধিদাত্রী এই সিদ্ধবিদ্যা দেবী বিগ্রহেরা।

মহাভাগবত পুরাণে আছে, শিব যখন এই বিচিত্র অভিনব দেবীমূর্তিদের একে একে দর্শন করতে করতে ভয় পেয়ে বলতে লাগলেন-“কোথায় গেলে আমার জীবনবল্লভা সতী আমাকে ছেড়ে, এই সব ভীতিপ্রদা মূর্তি এরাই বা কারা?” তখন সতী তাঁর স্বমূর্তিতে তাঁর সামনে আবির্ভূতা হয়ে বললেন, “এই তো আমি তোমার সামনেই আছি, তোমার ভয় কি?” তখন শিব জিজ্ঞাসা করলেন, “হে দাক্ষায়ণী সতী, তোমার সেই অপরূপ রূপ কি করে শ্যামা হয়ে গেল? আর এত ভয়ঙ্করী মূর্তিই হল কি করে?” দেবী তখন বললেন, অহং প্রকৃতিঃ সূক্ষ্মা, সৃষ্টিসংহারকারিণী। অভবংত্বদ্বনিতায়ৈ ত্বদর্থে গৌরদেহিকা।। ত্বামেব লিপ্সুঃ পুরুষং প্রাক্স্বীকৃতবশাৎ শিব। সাহং পিতুর্মহাযজ্ঞ বিনাশায় ভয়ানকা।।” আমিই আদি প্রকৃতি, কারণ-স্বরূপা, সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারকর্ত্রী। তবুও লীলা সম্পাদনের জন্য তোমার পত্নীত্ব স্বীকার করেছি। আর তোমারই জন্যে আমার শ্বেতবর্ণা শরীর। তোমার কাছে পূর্ব প্রতিজ্ঞাবশে আমি শরীর ধারণ করে তোমার পত্নী হয়েছি। সেই আমিই পিতার মহাযজ্ঞ ধ্বংস করবার জন্য এই ভয়ানক রূপ ধারণ করেছি। এই যা দেখলে, “সর্বা মমৈব”।

সব আমারই রূপ। সব আমিই, অতএব-“মা শম্ভো-ভয়ং কুরু।”- হে শম্ভু! ভয় কোরো না। এ যেন আদরের ছোট্ট ছেলেটিকে করুণাময়ী জননীর অভয় দিয়ে ভোলানোর চেষ্টা! সত্যিই তো, তিনিই যে আদি জননী-“ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশাদিন্ সর্বেষাং জননীপরা” তিনিই আদ্যাশক্তি পরমা জননী। দেবী সতী ছেলে ভোলানোর মতো করে বললেন, পতিদেবতার ভয় ভাঙানোর জন্য-“ত্বং মৎ প্রাণসমো ভর্তা, তবাহং বনিতা সতী।” তুমি আমা প্রাণসর্বস্ব স্বামী, আর আমি তোমারই প্রাণেশ্বরী স্ত্রী-সতী। তোমাকে ভয়ে পালিয়ে যেতে দেখে আমিই দশ দিকে তোমাকে আটকাবার চেষ্টা করেছি আমাকে দশ ভাগে ভাগ করে ছড়িয়ে দিয়ে।
শিব এই তত্ত্বস্বরূপিণী পত্নীরূপিণী মহাদেবীর স্বরূপ অবহিত হয়ে প্রার্থনা করলেন, “ত্বং মূলপ্রকৃতি সূক্ষ্মা সৃষ্টিস্থিত্যন্তকারিণী।

ত্বামজ্ঞাত্বা মোহামোহাত্তবাপ্রিয়তমং বচঃ। ময়োক্তং তন্মহাদেবি ক্ষমস্ব পরমেশ্বরী। মহাভয়ানকা এতা মূর্তয়স্তব যাঃ শিবে। আসাং নামানি মে ব্র“হি প্রত্যেকং ভীমলোচনে।” হে দেবী! তুমিই আদ্যা পরমাপ্রকৃতি মহাদেবী- সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার শক্তি। তোমার তত্ত্ব-স্বরূপ না জেনে বা ভুলে গিয়ে মহামোহবশতঃ তোমার অপ্রিয় কথা বলেছি, হে মহাদেবি তুমি আমার সেই অপরাধ ক্ষমা কর। মহাদেব আজ দেবীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে প্রর্থনা জানাচ্ছেন, “হে শিবানী, তোমার যে এই সব মহাভয়ঙ্করী মূর্তি, ভয়ানকদর্শনা লীলাবিগ্রহ এদের প্রত্যেকের নাম ও পরিচয় আমাকে জানাও।”

উত্তরে দেবী বললেন, “এতা সর্বা মহাদেব মহাবিদ্যা সমপ্রভাঃ।” এঁরা সকলে অনন্ত গুণবতী, তত্ত্বজ্ঞানময়ী। এঁদের নাম বলছি শোন। এই বলে-কালী-তারা-ষোড়শী-ভুবনেশ্বরী-ভৈরবী-ছিন্নমস্তা-সুন্দরী-বগলামুখী-ধূমাবতী-মাতঙ্গী এই দশটি নাম শোনালেন। এই পুরাণে কমলা নামটি নেই। তার বদলে ত্রিপুরাসুন্দরী আছে। অন্য পুরাণে এই ত্রিপুরাসুন্দরীকেই ষোড়শী বলা হয়েছে। তাঁরা কে কোন দিকে ছিলেন তাও দেবী বলেছিলেন, “সামনে কালী, ঊর্ধ্বদিকে তারা, দক্ষিণ দিকে ছিন্নমস্তা, বামে ভুবনেশ্বরী, পেছনদিকে বগলামুখী, বহ্নিকোণে ধূমাবতী, নৈর্ঋত কোণে ত্রিপুরাসুন্দরী, বায়ুকোণে মাতঙ্গী, ঈশানকোণে ষোড়শী, নীচের দিকে ভৈরবী-এই দশ মূর্তি আমারই রূপ।” এই বলে দেবী শিবকে এঁদের পূজাবিধিও বলে দিলেন। আরও বললেন, “অহং তব প্রিয়তমা, ত্বঞ্চ মে অতি প্রিয় পতিঃ। পিতু প্রজাপতের্দর্পনাশায় আশু ব্রজামহ্যম্, ত্বম্ আজ্ঞাপয় দেবেশ ত্বংন গচ্ছস্ িচেদ্ যদি। গচ্ছামি যজ্ঞনাশায় পিতুর্দক্ষ প্রজাপতেঃ।” আমি তোমার প্রিয়তমা পত্নী, আর তুমিও আমার একান্ত প্রিয়তম স্বামী। পিতা প্রজাপতি দক্ষের অহংকার চিরকালের জন্য মিটিয়ে দিতে জগতের মানুষের কাছে অহংকারের ফল কী হয় তা জানিয়ে দিতে তাঁর যজ্ঞ নষ্ট করবার জন্য আমি এখনই সেখানে যাব। হে দেবদেব, তুমি যদি না যাও তবে আমাকে অনুমতি দাও, আমি পিতাকে যথোচিত শিক্ষা দিতে তাঁর যজ্ঞ নষ্ট করতে সেখানে যাই।

এবারে শিব আর ভুল করলেন না। যাঁর ইচ্ছায় জগৎ চলে সেই ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছাকে আদেশ বলে মেনে নিয়ে তাঁর অনুচর প্রমথদের বললেন, নিয়ে এসো সিংহবাহিত রথ, নানা রত্নালঙ্কার। দেবীকে যথোচিতভাবে সাজিয়ে সেই রথে স্বয়ং বসিয়ে দিয়ে বললেন-“ত্বমাদ্যা পরমা বিদ্যা সর্বভূতেষু অবস্থিতা। স্বতন্ত্রা পরমাশক্তিঃ কস্তেবিধিনিষেধকঃ। ত্বঞ্চেদ্গমিষ্যসি শিবে দক্ষ-যজ্ঞবিনাশনে। কা মে শক্তিঃ ত্বাং নিষেদ্ধুং কথং তত্রাষ্মি বা ক্ষমঃ। তৎ ক্ষমস্ব মহেশানি যথারুচি তথা কুরু।” তুমি আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতি, সর্বজীবের অন্তরে বিরাজিতা স্বতন্ত্রা, তোমার কাছে আবার বিধিনিষেধ? তোমার যখন দক্ষযজ্ঞ নাশ করবার বাসনা হয়েছে তখন আমি কোন ছার যে তোমাকে নিষেধ করব? অতএব হে মহাদেবি, ভ্রমবশত আমি যা বলেছি সব ক্ষমা করে দাও। তোমার যেমন ইচ্ছা তাই হোক।

দেবীর অন্য সব মূর্তি তখন অন্তর্হিত হলেন। সতী একাই অপূর্ব সাজসজ্জায় সজ্জিতা হয়ে সেই দিব্য রথে উঠে দক্ষালয়ের দিকে গমন করলেন। সঙ্গে চললেন প্রমথগণের দল, নন্দীসহ।


Print