
মহাবিদ্যা - ছিন্নমস্তা

ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী এই সব অভয়দা মূর্তি দর্শন করে মহাদেব যখন একটু স্বাভাবিক হচ্ছেন তখন আর এক দিকে পালাতে গিয়ে সেদিকে দেখছেন আর একজন ভীমা ভয়ঙ্করী দেবীমূর্তিকে- ইনি ছিন্নমস্তা। ইনি রজঃপ্রধানা সত্ত্বগুণাত্মিকা, এঁর ধ্যানমন্ত্র বিরাট। অতি সংক্ষেপে সেটি বলা হচ্ছে-
“প্রত্যালীঢ়পদাং সদৈব দধতীং ছিন্নং শিরঃ কর্তৃকাং।
দিগ¦স্ত্রাং স্বকবন্ধশোণিতসুধাধারাং পিবন্তীং মুদা।।
নাগাবদ্ধ শিরোমণিং ত্রিনয়নাং হৃদ্যুৎপলালঙ্কৃতাং।
রত্যাসক্তমনোভবোপরি দৃঢ়াং ধ্যায়েৎ জবাসন্নিভাম্।।
অন্যমন্ত্রে, ভাস্বন্মণ্ডলমধ্যগতাং নিজশির-িন্নং বিকীর্ণালকং স্ফারাস্যং প্রপিবদ্গলাৎ স্বরুধিরং বামে করে বিভ্রতীম্। যাভাসক্তরতিস্মরো পরিগতাং সখ্যৌ নিজে ডাকিনী বর্ণিনৌ পরিদৃশ্যমোদকলিতাং শ্রীছিন্নমস্তাং ভজে।” মহাদেব দেখলেন কেমন এই ভয়ঙ্করী প্রচণ্ড চণ্ডিকা ছিন্নমস্তা দেবীকে। রক্তবর্ণা দেবী দাঁড়িয়ে আছেন একটি ত্রিকোণ যন্ত্রোপরি শায়িত এক মিথুনরত শরীরের উপরে পদ্মের উপর বাম পা সামনে দিয়ে। তিনি ছিন্নমস্তা-তাঁর বাঁ হাতে নিজের ছিন্নমুণ্ড ত্রিনেত্রা, বিস্তৃত লোলজিহ্বা তাতে। নিজের গলা থেকে নির্গত রক্তস্রোতধারা নিজের ছিন্নমুণ্ড পান করছে। সেই মুণ্ডের আলুলায়িত কেশরাশি ও কিরীটশোভিত। দিগম্বরী দেবীর ডানহাতে কাটারি, কণ্ঠে হাড়ের মালা ও সর্পের যজ্ঞোপবীত। সদা ষোড়শবর্ষীয়া দেবীর উন্মুক্ত বক্ষঃস্থল স্নেহপীযূষপূর্ণ। তাঁর বামে সখি ডাকিনী, দক্ষিণে বর্ণিনী-এঁরাও দিগম্বরী ও যথাক্রমে পীত ও রক্তবর্ণা। এরাও মুণ্ডকেশী, নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী, অস্থিমাল্যধারিণী। এঁদেরও ডান পা সামনে বাড়ানো। এঁদেরও বামহাতে কপাল ও ডানহাতে কাটারি। এঁরা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেবীর ছিন্নকণ্ঠ হতে উৎক্ষিপ্ত রুধিরধারা পান করছেন। এই নায়িকাদ্বয় পরিসেবিতা ভয়ঙ্করী দেবীরই অন্য নাম প্রচণ্ডচণ্ডিকা বা ছিন্নমস্তা।
এই ছিন্নমস্তা দেবীর উদ্ভব সম্পর্কেও একটি কাহিনি এক পুরাণে আছে। নারদপঞ্চরাত্রের মতে, একদিন দেবী পার্বতী তাঁর দুই সহচরীদের নিয়ে মন্দাকিনীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর মনে হঠাৎ কামনা জেগে ওঠে, তার ফলে তিনি অনুরাগে রক্তবর্ণা হন। তাঁর সহচরীদ্বয়ও এই সময় ক্ষুধার্ত হয়ে তাঁর কাছে খাদ্য প্রার্থনা করেন। দেবী তাঁদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন বাড়ি গিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করব। কিন্তু বারবার তারা ক্ষুধার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করলে এই জয়া-বিজয়া-ডাকিনী-বর্ণিনী রূপে মায়ের দুপাশ থেকে বলতে লাগলেন, “মাতা ত্বং সর্বজগতাম্, মাতরং প্রার্থয়েৎ শিশুঃ মাতা দদাতি সর্বেষাম ভোজনাচ্ছাদনাদিকম্। অতস্ত¡াং প্রার্থয়ে ভক্ষ্যং ভক্ষ্যর্থং করুণাময়ী।” তুমিই সকল জগতের মাতা। শিশু মায়ের কাছেই খাদ্য প্রার্থনা করে। হে কৃপাময়ী জননী, আজ তুমি আমাদের এই দারুণ ক্ষুধা দূর কর।” করুণাময়ী জননী তাদের এই প্রার্থনা শুনে হঠাৎ নিজের বাম নখাগ্র দিয়ে নিজেরই মস্তক ছিন্ন করে সেটি নিজের বামকরতলে ধারণ করলেন। ছিন্ন মস্তক ও কণ্ঠ থেকে ত্রিধারায় রক্তস্রোত প্রবাহিত হতে লাগল। বাম ও দক্ষিণ দিক থেকে নির্গত দুটি ধারা দুই সখি জয়া ও বিজয়ার ভয়ঙ্করী মূর্তি ডাকিনী ও বর্ণিনীর ঊর্ধ্বমুখ লেলিহান জিহ্বায় সংযোজিত হল। আর মধ্যধারাটি নিজ ছিন্ন মুখে পড়তে লাগল। এই ভাবে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে সখীদের পরিতৃপ্ত করেছিলেন বলে তাঁর নাম হল ছিন্নমস্তা। কী অপার করুণা মায়ের! সন্তানদের ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর করতে তিনি স্বেচ্ছায় সানন্দে নিজ মুণ্ড ছিন্ন করে নিজ রক্তে তাদের পরিতৃপ্ত করেন। আপাতদৃষ্টে রুদ্রাণী ভয়ঙ্করী মূর্তি হলেও এর পশ্চাৎপট ও তাৎপর্য অতন্ত করুণায় পরিমণ্ডিত।