Increase Reset Decrease

ভূমিকা

প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে ভারতে শক্তিপূজা প্রচলিত। পাঁচ সহস্রাধিক বৎসর পূর্বে পাঞ্জাবের হারপ্পা এবং সিন্ধু-দেশের মহেঞ্জোদারো নগরে দেবীপূজা হইত। উক্ত প্রাচীন নগরদ্বয়ের যে ধ্বংসাবশেষ সিন্ধুনদের তীরে ভূগর্ভ হইতে আবি®কৃত হইয়াছে তাহাতে অসংখ্য মৃন্ময়ী দেবীমূর্তি পাওয়া গিয়াছে। দেবী হিসাবে উক্ত দুই অধিবাসিগণের প্রধান দেবতা।

বেদে শক্তিবাদ:-
বৈদিক যুগেও শক্তিপূজা প্রচলিত ছিল। ঋগ্বেদের দেবীসূক্ত ও রাত্রিসূক্ত এবং সামবেদের রাত্রিসূক্ত হইতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক যুগে শক্তিবাদ বর্ধিত হইয়াছিল। অষ্টমন্ত্রাত্মক দেবীসূক্তের ঋষি ছিলেন মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক্। বাক্ ব্রহ্মশক্তিকে স্বীয় আত্মারূপে অনুভব করিয়া বলিয়াছিলেন, “আমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাদেবী ও বিশ্বেশ্বরী।”
সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ‘ভদ্রকালী’ নামটি আছে। হিরণ্য-কেশী গৃহ্যসূত্রে ভবানী দেবীকে যজ্ঞাহুতি দিবার ব্যবস্থা আছে। শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকাদেবী রুদ্রের ভগ্নীরূপে কথিত। আবার কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের মতো অম্বিকা রুদ্রের স্ত্রী। উক্ত আরণ্যকের নারায়ণ-উপনিষদে আছে-
তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।। ২
-আমি সেই বৈরোচিনী অর্থাৎ পরমাত্মা কর্তৃক দৃষ্ট অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তাপে শত্র“দহনকারিণী, কর্মফলদাত্রী দুর্গাদেবীর শরণাগত হই। হে সুতারিণি, হে সংসার-ত্রাণকারিণি দেবি, তোমাকে প্রণাম করি।
তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অন্তর্গত যাজ্ঞিকা উপনিষদে এই গুর্গা গায়েত্রীটি আছে-‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে, কন্যাকুমারীং ধীমহি, তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ’ (১০।১।৭)।
সায়নাচার্যের ভাষ্যানুযায়ী দুর্গি ও দুর্গা অভিন্ন।

বেদ ও চণ্ডী :-
শ্রীশ্রীচণ্ডী বেদমূলা। ইহার প্রথম চরিত্র ঋগ্বেদস্বরূপা, মধ্যম চরিত্র যজুর্বেদস্বরূপা ও উত্তর চরিত্র সামবেদস্বরূপা। চরিত্রত্রয়ের ছন্দ যথাক্রমে গায়েত্রী, উষ্ণিক্ ও অনুষ্টুপ্। ঋগ্বেদের মতে উক্ত ছন্দত্রয়-দ্বারা মন্ত্রপাঠে যথাক্রমে ব্রহ্মতেজ-লাভ, আয়ু-বৃদ্ধি ও পরমানন্দ প্রপ্তি হয়। চণ্ডীজপের প্রারম্ভেই গায়েত্রী ছন্দোরূপে আবির্ভূতা। গায়েত্রী বেদমাতা ও শ্রেষ্ঠ বেদমন্ত্র। ত্রিসন্ধ্যা গায়েত্রীজপ বেদবিহিত। গায়েত্রী প্রাতে ঋগ্বেদধারিণী কুমারী, মধ্যহ্নে যজুর্বেদধারিণী যুবতী এবং সায়াহ্নে সামবেদধারিণী বৃদ্ধা। কুমারীর ন্যায় মহাকালী ব্রহ্মরূপা ব্রাহ্মী, যুবতীর ন্যায় মহালক্ষ্মী বিষ্ণুরূপা বৈষ্ণবী এবয় বৃদ্ধার ন্যায় মহাসরস্বতী শিবরূপা মাহেশ্বরী। চণ্ডী ও গাযেত্রী উভয়েই প্রণবস্বরূপা। শাস্ত্রে আছে, “ঋগ্ভিঃ ¯ত্তবন্তি, যজুর্ভিঃ যজন্তি, সামভিঃ গায়ন্তি।” অর্থাৎ ঋঙ্ মন্ত্র দ্বারা পরমাত্মার স্তব, যজুর্মন্ত্র দ্বারা তাঁহার পূজন এবং সামমন্ত্র দ্বারা তাঁহার ভজন হয়। চণ্ডী পরমাত্মময়ী। বেদমাতাই চণ্ডীরূপে প্রকটিতা।

বৌদ্ধধর্মে শক্তিবাদ:-
হিন্দুদের নিত্যপাঠ্য ধর্মগ্রন্থ চণ্ডীখানি এক সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসিগণের প্রিয় হইয়াছিল। জনৈক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর স্বহস্তে লিখিত একখানি চণ্ডী নেপালে পাওয়া গিয়াছে। উহা প্রায় এক সহস্র বৎসর পূর্বে লিখিত। কয়েকখানি প্রসিদ্ধ হিন্দুতন্ত্রে কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা- এই দশমহাবিদ্যার যে বর্ণনা আছে তৎসমুদয় বৌদ্ধতন্ত্র হইতে গৃহীত। ইহা বৌদ্ধ-তন্ত্র ‘সাধনমালা’ পরিদৃষ্টে বুঝা যায়। উগ্র, মহোগ্রা, বজ্রা, কালী, সরস্বতী, কামেশ্বরী, ভদ্রকালী, ও তারা-দেবীর এই অষ্টরূপের মন্ত্রাবলীও বৌদ্ধতন্ত্র হইতে প্রাপ্ত। বিনয়বাবুর মতে সরস্বতী ও কালী বংলার এই জনপ্রিয় দেবীদ্বয় বৌদ্ধতন্ত্রের সৃষ্টি।

জৈনধর্মে শক্তিবাদ:-
জৈনধর্মেও শক্তিবাদ প্রবেশ করিয়াছিল। রাজপুতানার আবু পাহাড়ে যে বিখ্যাত শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত সুবৃহৎ জৈন মন্দির বিরাজিত, তাহার চূড়াতে ষোলটি জৈন দেবীর বিভিন্ন মূর্তি খোদিত আছে। কাথিয়া-বাড়ের গিরনায় পর্বতে পাষাণনির্মিত সরস্বতীর মূর্তি ছিল। জৈনধর্মের উভয় সম্প্রদায়ের মন্দিরে সরস্বতী ও অন্যান্য দেবীর মূর্তি দেখা যায়। জৈনগণ সরস্বতীকে শাসনদেবীরূপে ভক্তি করেন।

মহাভারতে শক্তিবাদ:-
ভীষ্মপর্বের ২৩শ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে জয়লাভের জন্য যুদ্ধারম্ভের পূর্বে দুর্গাদেবীকে প্রণাম ও প্রর্থনা করিতে উপদেশ দিয়াছেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে ও হরিবংশে শক্তিবাদের পরিপুষ্টি হইয়াছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ তম হইতে ৯৩ তম - এই তেরটি অধ্যায়কেই দেবী-মাহাত্ম্য বা ‘চণ্ডী’ বলে। হরিবংশের ৫৯ তম এবং ১৬৬ তম অধ্যায়দ্বয়ে দেবী¯ত্ততিতে শক্তিবাদ সুষ্পষ্ট। মহাভারতে দেবীর ভদ্রকালী, চণ্ডী প্রভৃতি নামও আছে; কিন্তু দেবীর চামুণ্ডা-নামটি মহাভারতে পাওয়া যায় না। শ্রীশ্রীচণ্ডীর মতে শরৎকালেই সুরথ ও সমাধি দেবীপূজা করেন। দেবী-ভাগবতের মতে শরৎকালেই দুর্গাপূজার উৎপত্তি।

পুরাণে শক্তিবাদ:-
সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে পুরাণসমূহেও শক্তিবাদ সম্যক্ সমৃদ্ধ হইয়াছিল। বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, দেবীভাগবত, বামনপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বৃহন্নারদীয় পুরাণাদিতে শক্তিবাদের সমধিক সমৃদ্ধি দেখা যায়।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে (২।৬৬।৭-১০) আছে, মহাশক্তি মূলা প্রকৃতি হইতে বিশ্ব উৎপন্ন এবং তিনিই বিশ্বপ্রপঞ্চের সারভূতা পরা সত্তা। বৃহন্নারদীয় পুরাণে দেবীকে সর্বশক্তিমতী বিশ্বপ্রসবিনীরূপে বর্ণনাস্তে বলেন,
উমেতি কেচিদাহুস্তাং শক্তিং লক্ষ্মীং তথাপরে।
ভারতীত্যপরে চৈনাং গিরিজেত্যমইবকেতি চ।।
দুর্গেতি ভদ্রকালীতি চণ্ডী মারহশ্বরীতি চ।
কৌমারী বৈষ্ণবী চেতি বারাহীতি তথাপরে।।
-সেই দেবীকে কেহ শক্তি, কেহ উমা, কেহ বা লক্ষ্মী বলেন। ভারতী, গিরিজা, অম্বিকা, দুর্গা, ভদ্রকালী, চণ্ডী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী প্রভৃতি নামেও তিনি অভিহিতা।
দেবীভাগবতের মতে সর্বভূতে শক্তি আত্মারূপে বিদ্যমান এবং প্রাণী শক্তিহীন নিষ্ক্রিয় হয়। উক্ত পুরাণ অনুসারে পরম পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত-এক ভাগ সচ্চিদানন্দ এবং দ্বিতীয় ভাগ পরাশক্তি, মায়াপ্রকৃতি। কিন্তু দুই ভাগ মূলতঃ অভিন্ন। বহ্নি ও তৎশক্তির ন্যায় পরম পুরুষ ও পরমা প্রকৃতি অদ্বৈত। দেবীভাগবতে আছে-
সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিণী।
রূপং বিভর্ত্যরূপা চ ভক্তানুগ্রহহেতবে।।
-সেই সচ্চিদানন্দরূপিণী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হইয়াও ভক্তগণকে কৃপা করিবার জন্য রূপ ধারণ করেন।

বাংলাভাষার শাক্ত সাহিত্য:-
শক্তিবাদের স্রোত সমগ্র ভারত প্লাবিত করিলেও বাংলা দেশে ইহা বিশেষ পরিপুষ্ট হইয়াছে। বাংলার ধর্মগঙ্গার দেবীভক্তি অন্যতম প্রধান ধারা। বাংলাভাষায় প্রাচীন কাল হইতে বিশাল শাক্ত সাহিত্য সৃষ্ট হইয়াছে। বাংলাদেশে চণ্ডীর বহু অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে।
পঞ্চদশ শতাব্দী হইতে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাভাষায় বিশাল শাক্ত সাহিত্য রচিত হইয়াছে। এই পাঁচশত বৎসর চণ্ডী, দুর্গা, অম্বিকা, সরস্বতী, ষষ্ঠী, লক্ষ্মী, গঙ্গা প্রভৃতি দেবীর মাহাত্ম্য-প্রচারোদ্দেশ্যে বহু কাব্যগ্রন্থ প্রণীত হইয়াছিল।

তন্ত্রের প্রাধান্য:-
অনান্য ধর্ম অপেক্ষা হিন্দুধর্মেই শক্তিবাদ সমধিক সমৃদ্ধ। হিন্দু তন্ত্রশাস্ত্রেই শাক্ত দর্শন বিশদভাবে ব্যাখ্যাত এবং চণ্ডীতে ইহার পূর্ণ পরিণতি দৃষ্ট হয়। হিন্দু তন্ত্রশাস্ত্র সুবিশাল। শত শত হিন্দু তন্ত্রগ্রন্থ প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত আছে। মহাসিদ্ধসারতন্ত্রমতে জগৎ প্রাচীন যুগে বিষ্ণুক্রান্তা, রথক্রান্তা, অশ্বক্রান্তা- এই তিন ভাগে বিভক্ত। শক্তিমঙ্গলতন্ত্রমতে বিন্ধ্যপর্বত হইতে পূর্বদিকে যবদ্বীপ পর্যন্ত সকল দেশ বিষ্ণুক্রান্তা এবং বিন্ধ্যপর্বত হইতে পশ্চিমে পারস্য, মিশর ও রোডেসিয়া প্রভৃতি দেশ অশ্বক্রান্তা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। সুদূর মিশর দেশেও মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। শক্তিমঙ্গলতন্ত্রানুসারে ভারতভূমিও তিন ভাগে বিভক্ত। বিন্ধ্যাচল হইতে চট্টলভূমি পর্যন্ত বিষ্ণুক্রান্তা, বিন্ধ্যাচল হইতে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রদেশ অশ্বক্রান্তা বা গজক্রান্তা এবং বিন্ধ্যাচল হইতে নেপাল, মহাচীন প্রভৃতি দেশ রথক্রান্তা নামে বিখ্যাত ছিল।

তান্ত্রিক ভারত:-
সমগ্র তন্ত্রশাস্ত্রের সার চণ্ডীর মধ্যে নিহিত। সেইহেতু শাক্তগ্রন্থসমূহের মধ্যে চণ্ডী এত সারবতী ও সমাদৃত। গীতার ন্যায় ইহা হিন্দুর নিত্যপাঠ্য। চণ্ডীপাঠ দেবীপূজার প্রধান অঙ্গ। মহাভারতের একান্নটি দেবীপীঠস্থানে বা শক্তিসাধনার কেন্দ্রে চণ্ডী নিয়মিতভাবে পঠিত হয়। কুলার্ণবতন্ত্রমতে তান্ত্রিক সাধনাই প্রশস্ত।
গীতা যেমন মহাভারতের অংশ, চণ্ডী তদ্রূপ মার্কণ্ডেয়পুরাণের অংশ। মার্কণ্ডেয়পুরাণের ৮১ হইতে ৯৩ অধ্যায়ে পর্যন্ত ত্রয়োদশ অধ্যায়ের নামই ‘চণ্ডী’।
দেবীমাহাত্ম্য ও দুর্গাসপ্তশতী চণ্ডীর অপর দুইটি নাম। দুর্গাহোম সপ্তশত আহুতিপ্রদানের নিমিত্ত শ্রীশ্রীচণ্ডী সপ্তশত মন্ত্রে বিভক্ত হইয়াছে। এই কারণে ইহার একটি নাম সপ্তশতী। কিন্তু দেবীমাহাত্ম্যই ইহার মার্কণ্ডেয়পুরাণোক্ত নাম। ইহাতে সাতশত মন্ত্র, অথবা ৫৭৮ টি শ্লোক আছে। রুদ্রযামলতন্ত্রের ‘রুদ্রচণ্ডী’ এবং বাণভট্টের ‘চণ্ডীশতক’ দেবীমাহাত্ম্য- অবলম্বনেই লিখিত। এই প্রসঙ্গে আনন্দবর্ধনের ‘দেবীশতক’ও উল্লেখযোগ্য।

শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রাচীনতা:-
প্রাচীন বৌদ্ধতন্ত্র ‘গুহ্যসমাজতন্ত্র’ ও ‘চণ্ডী’ একই শতাব্দীতে সৃষ্ট। বারাহীতন্ত্র, স্কন্দপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবীভাগবত, কালিকাপুরাণ, বামনপুরাণ, ও বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণাদিতে চণ্ডীর অস্তিত্ব স্বীকৃত হইয়াছে। চণ্ডীর ১১।৪২ মন্ত্রে আছে যে, দেবী নন্দগোপগৃহে যশোদাগর্ভে আবির্ভূতা হইবেন। ইহা হইতে মনে হয়, ভাগবতের পূর্বে চণ্ডী রচিত। ‘শঙ্করদিগি¦জয়’ গ্রন্থে চণ্ডীর উল্লেখ আছে। সুতরাং চণ্ডী সম্ভবতঃ ৩য় শতাব্দীতে বা তৎপূর্বে রচিত হইয়াছিল। মার্কণ্ডেয়-পুরাণের মতে শকগণ মধ্যদেশের (মধ্যভারতের) অধিবাসী।

বাংলাই চণ্ডীর জন্মস্থান:-
কাহারও কাহারও মতে চণ্ডী নর্মদা অঞ্চলে বা উজ্জয়িনীতে উৎপন্ন। কিন্তু অধ্যাপক দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী ঐতিহাসিক যুক্তি দ্বারা উক্ত মত খণ্ডন করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে, সম্ভবতঃ বাংলাদেশেই চণ্ডীর জন্মস্থান। পুরাণের অংশ হইলেও চণ্ডী তন্ত্রশাস্ত্ররূপে গৃহীত। যখন প্রধান প্রধান সকল তন্ত্রই বাংলায় উৎপন্ন, তখন চণ্ডীও সম্ভবতঃ বাংলাই উদ্ভূত। বাংলার পূর্ব সীমান্তে চট্টল শহর হইতে দশ বার মাইল দূরে করালডাঙ্গা পাহাড়ে অবস্থিত মেধসাশ্রম কি চণ্ডীতে উক্ত মেধা মুনির আশ্রম? উপরিঊক্ত মতের অনুকূল আর একটি বলবতী যুক্তি দেওয়াযাইতে পারে। চণ্ডীর ত্রয়োদশ অধ্যায়ের দশম শ্লোকে আছে-সুরথ ও সমাধি মহামায়ার ‘মহীময়ী’ মূর্তি নির্মাণ করিয়া পূজা করিয়াছিলেন। মৎস্যপুরাণে দুর্গামূর্তি-নির্মাণের ব্যবস্থা আছে। মহীময়ী মূর্তি বাংলাদেশে প্রচলিত মৃন্ময়ী প্রতিমা ব্যতীত অন্য কিছু নহে। বাংলাদেশ ব্যতীত ভারতের অন্য কোন প্রদেশে মৃন্ময়ী প্রতিমায় দুর্গাপূজার প্রচলন নাই। অন্যান্য প্রদেশে ধাতু, কাষ্ঠ বা প্রস্তর দ্বারা নির্মিত মূর্তিপূজাই সমধিক প্রচলিত।

শ্রীশ্রীচণ্ডীর টীকাবলী:-
গীতার ন্যায় চণ্ডীর প্রায় ত্রিশটি টীকা আছে।
কাত্যায়নীতন্ত্রে চণ্ডীর প্রত্যেক মন্ত্রটি স্পষ্টভাবে বিভাগ করা হইয়াছে। উক্ত তন্ত্রে চণ্ডীর প্রয়োগবিধিও প্রসিদ্ধ। বারাহীতন্ত্রে ও রুদ্রযামলে চণ্ডীর মন্ত্রবিভাগ সংক্ষিপ্ত। কাত্যায়নীতন্ত্রসম্মত মন্ত্রবিভাগই এই চণ্ডীতে গৃহীত এবং বিশেষরূপে প্রচলিত। কাত্যায়নীতন্ত্রে আছে-
তশ্মাদেতৎ পঠিত্বৈব জপেৎ সপ্তশতীং পরাম্।
অন্যথা শাপমাপ্নোতি হানিং চৈব পদে পদে।।
রাবণাদ্যাঃ স্তোত্রমেতদ্ অঙ্গহীনং নিষেবিরে।
হতা রামেণ তে যস্মাৎ নাঙ্গহীনং পঠেৎ ততঃ।।
-চণ্ডীপাঠের সঙ্গে চণ্ডীর ষড়ঙ্গ (কবচাদিত্রয় ও রহস্যত্রয়) পাঠ বিধেয়। ষড়ঙ্গহীন চণ্ডীপাঠকের উপর দেবীর শাপ পতিত হয় এবং পদে পদে বিপদ আছে। রাবণাদি অঙ্গহীন চণ্ডীপাঠ করায় রামচন্দ্র কর্তৃক নিহত হন। সুতরাং সঙ্কল্পপূর্বক অঙ্গহীন চণ্ডীপাঠ অনুচিত।

রুদ্রচণ্ডী:-
রুদ্রযামল তন্ত্রের পুষ্পিকাকল্পে তুর্যখণ্ডে ‘রুদ্রচণ্ডী’ আছে। ইহা শ্রীশ্রীচণ্ডী-অবলম্বনে রচিত। ইহাতে চণ্ডীর উল্লেখও দেখা যায়। রুদ্র দেবীকে বলিতেছেন, “পূর্বে তোমাকে যে দেবীমাহাত্ম্য বলিয়াছি, তাহা তুমি মনোযোগ সহকারে শোন নাই। তাই তোমাকে পুনরায় ইহা সংক্ষেপে বলিতেছি।” রুদ্রচণ্ডীর উপর ব্রহ্মা ও কৃষ্ণের অভিশাপ পতিত হয়। সেইজন্য চণ্ডীর দুইটি শাপ-বিমোচন মন্ত্র আছে। রুদ্রচণ্ডীর শাপোদ্ধার-মন্ত্র, গায়েত্রী ও কবচ শ্রীশ্রীচণ্ডীর কবচাদি হইতে পৃথক্। রুদ্রচণ্ডীর তিনটি অবচ্ছেদ আছে। প্রথম অবচ্ছেদ ৪৭-শ্লোকবিশিষ্ট। উহাতে চণ্ডীরহস্য কথিত এবং সমাধি ও সুরথের উপাখ্যান এবং মধুকৈটভাদি-বধ বর্ণিত। মধ্যম অবচ্ছেদ মাত্র ৩৭ টি শ্লোকযুক্ত। উহাতে সাধনরহস্য কথিত। অন্তিম অবচ্ছেদ ১০৫ টি শ্লোক আছে। উহাতে রুদ্রচণ্ডী-পাঠের ফল ও প্রলম্বাসুর-বধের উপাখ্যান উক্ত। প্রলম্বাসুরের উল্লেখ শ্রীমদ্ভাগবতে আছে। ‘দুর্গাসপ্তশতীর’ বহুল প্রচারমানসে সম্ভবতঃ রুদ্রচণ্ডীর উৎপত্তি। উহাকে চণ্ডীর সংক্ষিপ্ত ও সরল সংস্করণ বলিলে অত্যুক্তি হয় না। কোথাও কোথাও উহা এখনও প্রচলিত আছে। রুদ্রচণ্ডীর ধ্যানটি এইরূপ -
রক্তাবর্ণাং মহাদেবীং লসচ্চন্দ্রবিভূষিতাম্।
পট্টবস্ত্রপরীধানাং সর্বালঙ্কারভূষিতাং।
বরাভয়করাং দেবীং মুণ্ডমালাসুশোভিতাম্।।১
কোটীচন্দ্রসমাভাসাং বদনৈঃ শোভিতাং পরাৎ।
করালবদনাং দেবীং কিঞ্চিজ্জিহ্বাগ্রলোহিতাম্।।২
স্বর্ণবর্ণমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাং।
অক্ষমালাধরাং দেবীং জপকর্মসমাহিতাম্।।৩
-রুদ্রচণ্ডী দেবী রক্তবর্ণা, ললাটে চন্দ্রভূষণা, পট্টবস্ত্র-পরিহিতা, অলঙ্কারশোভিতা, বরাহভয়করা, গলে মুণ্ডমালাধারিণী, কোটিচন্দ্রবৎ জ্যোতির্ময়-বদনযুক্তা, করালবদনা, জিহ্বাগ্র কিঞ্চিৎ রক্তলিপ্তা, সুবর্ণ-কান্তি শিবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা, জপমালা-ধরা ও জপে নিযুক্তা।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর ১।৫৫, ৪।১৭, ১১।১০, ১১।১২, ১১।২৪, ১১।২৯, এবং ১১।৩৯ শ্লোক-সপ্তককে সপ্তশ্লোকী চণ্ডী বলে। এই সাতটি শ্লোকের অর্থ-ভাবনা করিলেই চণ্ডীতত্ত্ব অবগত হওয়া যায়।

চণ্ডীর সপ্তশতী নামের সার্থকতা:-
এই দুর্গাসপ্তশতী চণ্ডীদেবীর স্বরূপবাচক মন্ত্র-শরীররূপে নানা তন্ত্রে প্রসিদ্ধ। এইজন্য ইহার নাম চণ্ডী। চণ্ড=চণ্ড+(স্ত্রীলিঙ্গে) ঈপ্ =পরব্রহ্মমহিষী বা ব্রহ্মশক্তি। চণ্ড শব্দের অর্থ দেশকালাদির দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন পরব্রহ্ম। ‘চণ্ডভানু’, ‘চণ্ডবাদ’ ইত্যাদি পদে ‘চণ্ড’ শব্দটি ইয়ত্তা বা সীমা দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন অসাধারণ গুণশালিত্ব-অর্থে সূচিত হইয়াছে। ধর্ম ধর্মী, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তি অভিন্ন হইলেও ভিন্নরূপে ব্যবহৃত হয়। ব্রহ্মশক্তিই চণ্ডী। সৃজনোন্মুখ ব্রহ্মের ঈক্ষণাদি সমস্ত ধর্মকে লক্ষ্য করিয়া চণ্ডী, আদ্যাশক্তি, মহামায়া প্রভৃতি নাম প্রযুক্ত হইয়াছে। ‘স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ’-এই শ্র“তিবাক্যে ব্রহ্মধর্ম ও ধর্মিব্রহ্ম স্বরূপতঃ এক অভিন্নরূপে উপদিষ্ট হইয়াছেন। ব্রহ্মের ধর্মত্বহেতু এই জ্ঞানাদি শক্তিত্রয়রূপে অভিহিত হয়। এই ধর্ম পূর্বমীমাংসা-শাস্ত্রোক্ত চোদনা-লক্ষণ জড়ধর্ম নহে। পরšত্ত উহা ব্রহ্মধর্ম বা চিৎশক্তি। জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়া-এই শক্তিত্রয়ের সমষ্টিভূতা ব্রহ্মাভিন্না তুরীয়া দেবীই চণ্ডী বা চণ্ডিকা নামে প্রসিদ্ধা। তন্ত্রান্তরে চণ্ড দেবীর অন্যান্য বহু নাম আছে। ব্যষ্টিভূতা জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি যথাক্রমে মহাসরস্বতী, মহাকালী ও মহালক্ষী নামে নির্দিষ্টা হইয়াছেন। সেই পরম সত্তা চণ্ডীই বিশ্বব্যাপিনী এবং সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের শক্তিরূপিনী। এই দেবীর সত্তা পারমার্থিকী ও ত্রিকালাবাধিতা।

চণ্ডীর প্রতিপাদ্য বিষয়:-
মহামায়া-তত্ত্বই সমগ্র তন্ত্রশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। তন্ত্রশাস্ত্রের সারস্বরূপা চণ্ডীর প্রতিপাদ্য বিষয়ও মহামায়ার স্বরূপ। শ্রীঅরবিন্দের ‘মা’ নামক গ্রন্থখানিও চণ্ডীতত্ত্বের একটি সুললিত ব্যাখ্যা। মহামায়া-শব্দ চণ্ডীতে আট বার ব্যবহৃত হইয়াছে। চণ্ডীতে যোগমায়া-শব্দটির উল্লেখ নাই। কিন্তু মহামায়া-শব্দের পরিবর্তে যোগনিদ্রা ও বিষ্ণুমায়া শব্দদ্বয়ের ব্যবহার কয়েক বার দেখা যায়। অথচ তন্ত্রশাস্ত্রে মহামায়া, যোগমায়া, যোগনিদ্রা, ও বিষ্ণুমায়া এই শব্তচতুষ্টয় একার্থবোধক। গীতাতে যোগমায়া-শব্দটি মাত্র একবার আছে। গীতায় ভগবান বলিতেছেন যে, অবতারপুরুষ যোগমায়া-সমাবৃত হইয়াই লীলাদি কার্য করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে যোগমায়া ও বিষ্ণুমায়া শব্দের বহুবার উল্লেখ আছে। মহামায়া কাত্যায়নাশ্রমে আবির্ভূতা হইয়াছিলেন বলিয়া চণ্ডীতে তিনি ‘কাত্যায়নী’ নামেও অভিহিতা। এই কাত্যায়নীই ব্রজের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং ব্রজঙ্গনাগণ মনোমত পতি-লাভের জন্য তাঁহার আরাধনা করিতেন। ব্রজকুমারীগণ প্রার্থনা করিতেন-
কাত্যায়নি মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরি।
নন্দগোপসুতং দেবি পতিং মে কুরু তে নমঃ।।
অর্থাৎ হে কাত্যায়নি মহামায়ে মহাযোগিনি অধীশ্বরি দেবি, নন্দগোপপুত্র কৃষ্ণকে আমার পতি কর। তোমাকে নমস্কার করি। ভাগবতে কাত্যায়নী দেবীকে চণ্ডিকা, ভদ্রকালী, নারায়ণী প্রভৃতি নাম দেওয়া হইয়াছে। ভাগবতের টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে মহামায়া ও যোগমায়া পৃথক্।

শক্তি সিদ্ধান্ত:-
এক অদ্বিতীয় নিরতিশয় চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম অনাদিসিদ্ধ মায়ার আবরণে ধর্ম এবং ধর্মিরূপে প্রতিভাসিত হন। নানা উপনিষদে ব্রহ্মের ঈক্ষণ বহুভাবে বর্ণিত। এই ঈক্ষণই ব্রহ্মের নিত্য-জ্ঞান-ইচ্ছা-ক্রিয়া। ইহাকে সার জন উড্রফ 'ঈৎবধঃরাব রসধমরহধঃরড়হ' বলিয়াছেন। এই জ্ঞান-ইচ্ছা-ক্রিয়াই ব্রহ্মধর্ম । ধর্ম স্বরূপতঃ ধর্মী হইতে অভিন্ন। অগ্নি ও তাহার উত্তাপকে যেমন পৃথক করা যায় না, ধর্ম ও ধর্মীকেও তদ্রূপ স্বতন্ত্রকরা সম্ভব নহে। এই ধর্মের অপর নাম শক্তি। ব্রহ্মধর্ম উপাসকভেদে পুরুষরূপে ও নারীরূপে প্রতিভাত হন। পুরুষরূপে তিনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। ব্রহ্মের সৃষ্টিশক্তিই ব্রহ্মা, স্থিতিশক্তিই বিষ্ণু এবং সংহার-শক্তিই শিবরূপে উপাসিত হন। ব্রহ্মধর্ম নারীরূপে আদ্যাশক্তি ভবানী। স্বচ্ছ স্ফটিকে লাল জবাফুলের প্রতিবিম্ব পড়িলে যেমন ইহা লাল দেখায়, তদ্রূপ ধর্মের কর্তৃত্বাদি গুণের প্রভায় নিষ্ক্রিয় ধর্মীও কর্তৃত্বাদি বিশিষ্টরূপে প্রতীত হন। ব্রহ্মরূপ ধর্মীর ধর্ম জড় নহে, জীবও নহে। পরšত্ত উহা চিতি, চৈতন্য। চণ্ডীতে (৫।৩৪) আছে- ‘চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নমেতদ্ ব্যাপ্য স্থিতা জগৎ’ অর্থাৎ চিতিরূপে আদ্যাদেবী সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত করিয়া অবস্থিত। শাক্ত সিদ্ধান্তের মতে চিৎশক্তিই জগৎ সৃষ্টি করেন। বেদান্তমতে মায়াশক্তিশবলিত ব্রহ্মেই জগৎ প্রসব করেন। এই বিষয়ে উভয় সিদ্ধান্তে মূলতঃ ভেদ নাই। উভয় মতের পার্থক্য এই যে, বেদান্তমতে ব্রহ্মধর্ম মায়িক। কিন্তু শাক্তমতে ধর্মী, ও ধর্ম, শক্তি ও শক্তিমান্ অভিন্ন, এক; ধর্ম বিদ্রূপা, পারমার্থিক। শাক্ত সিদ্ধান্তের সারতত্ত্ব এই যে, মহাশক্তি ব্রহ্মধর্মরূপা। ধর্ম জগৎকারণ ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন বলিয়া চিদ্রূপিণী সদ্রূপিণী ও আনন্দময়ী এবং এই জগৎ ব্রহ্মশক্তির পরিণাম।

শ্রীশ্রীচণ্ডীতত্ত্ব:-
চণ্ডীর বাক্যবলীদ্বারাও ইহা প্রমাণিত হয়। দেবীকে চণ্ডীর ১।৫৪ মন্ত্রে ‘জগন্মূর্তি’, ১।৭৭ মন্ত্রে ‘জগন্ময়ী’,১১।৪ মন্ত্রে ‘মহীস্বরূপা’ এবং ১১।৩৩ মন্ত্রে ‘বিশ্বরূপা’ বলা হইয়াছে। ইহাই বিশ্বদেবীর বিরাট রূপ। মুণ্ডক-উপনিষদে (২।২।১১) আছে, ‘ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্’- এই জগৎ শ্রেষ্ঠতম ব্রহ্মই। পূজার আসনশুদ্ধির মন্ত্রে পৃথিবী দেবীরূপে সম্বোধিতা। দেবী-সূক্তের শেষে আছে যে, ব্রহ্মময়ী দেবী পৃথিবী ও আকাশের অতীত হইয়াও পরিদৃশ্যমান বিশ্বরূপ ধারণ করিয়াছেন। মহামায়া দেবী মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী ও মহাকালী-এই তিন রূপে প্রকাশিতা। মহাকালী তামসী ও ঋগ্বেদরূপা। মহালক্ষ্মী রাজসী ও যর্জুর্বেদরূপা এবং মহাসরস্বতী সাত্ত্বিকী ও সামবেদরূপা। সরস্বতী বাংলায় মরালবাহনা, দাক্ষিণাত্যে ময়ূরবাহনা। সচ্চিদানন্দময়ী দেবীর গুণভেদে তিনটি ব্যষ্টিরূপ মূলতঃ এক ও অভেদ। শাস্ত্রে আছে -
মহাসরস্বতী চিত্তে মহালক্ষ্মী সদাত্মকে।
মহাকাল্যানন্দদরূপে তত্ত্বজ্ঞানসুসিদ্ধয়ে।।
অণুসন্দধ্মহে চণ্ডি বয়ং ত্বাং হৃদয়াম্বুজে।
অর্থাৎ মহাসরস্বতী চিদ্রূপা, মহালক্ষ্মী সদ্রূপা এবং মহাকালী আনন্দরূপা। হে চণ্ডিকে, তত্ত্বজ্ঞানলাভের জন্য তোমাকে হৃদয়পদ্মে ধ্যান করি। দেবীভাগবতে আছে-
সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ।
যোহসৌ সাহম্ অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ।।
-অর্থাৎ আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নাই।

দেবীর নামাবলী:-
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর নিম্নোক্ত নামাবলী আছে- চণ্ডিকা, চামুণ্ডা, নারায়ণী, শাকম্ভরী, সরস্বতী, সনাতনী, মহামায়া, শতাক্ষী, রক্তদন্তিকা, ভগবতী, জগদ্ধাত্রী, বিশ্বেশ্বরী, দেবজননী, বেদজননী, সাবিত্রী, মহাদেবী, মহাসুরী, পরমেশ্বর, তামসী, রাজসী, সাত্ত্বিকী, শিবা, সিংহবাহিনী, খড়্গিনী, কালী, গদিনী, ভদ্রকালী, শঙ্খিনী, শূলিনী, চক্রিণী, চাপিনী, অম্বিকা, ঈশ্বরী, বরদা, শ্রী, মহেশ্বরী, ত্রয়ী, দুর্গা, গৌরী, লক্ষ্মী, অলক্ষ্মী, অপরাজিতা, পার্বতী, কল্যাণী, ভীমাক্ষী, ভৈরবনাদিনী, ব্রহ্মণী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বারাহী, নারসিংহী, ঐন্দ্রী, শিবদূতী, কাত্যায়নী, সর্বেশ্বরেশ্বরী ইত্যাদি।

মহিষমর্দিনী মূর্তি:-
বৈকৃতিক-রহস্যের মতে দেবী সহস্রভুজা হইলেও তিনি অষ্টাদশভুজারূপা পূজ্যা ও ধ্যেয়া। এখানে সহস্র শব্দ অনস্তবাচী। সুতরাং দেবী অনন্তভুজা অর্থাৎ বিশ্বব্যাপিনী। চণ্ডীর অন্য একস্থলে দেবীকে সহস্রনয়না অর্থাৎ বিশ্বতশ্চক্ষু বলা হইয়াছে। চণ্ডীর ৫ম অধ্যায়ে দেবতাগণ মহামায়াকে স্তব করিবার সময় বলিয়াছেন যে, চেতনা, বুদ্ধি, নিদ্রা, ক্ষুধা, ছায়া, শক্তি, তৃষ্ণা, ক্ষান্তি, জাতি, লজ্জা, শাস্তি, শ্রদ্ধা, কান্তি, লক্ষ্মী, বৃত্তি, স্মৃতি, দয়া, মাতা, তুষ্টি ও ভ্রান্তিরূপে, দেবী সর্বভূতে বিরাজিতা। শুধু তাহাই নহে, মানবদেহের প্রত্যেক অঙ্গে এবং বিশ্বের প্রত্যেক বস্তুতে দেবী প্রকাশিতা।

মহামায়া বিশ্বব্যাপিনী হইলেও নারীমূর্তিতে তাঁহার সমধিক প্রকাশ-ইহা চণ্ডীর নারায়ণী¯ত্ততিতে উক্ত। দেবীর অংশে নারীমাত্রেরই জন্ম। অল্পবয়স্কা, সমবয়স্কা বা বয়োবৃদ্ধা নারীমূতি জগদম্বারই জীবন্ত বিগ্রহ। প্রত্যেক নারীতে মাতৃবুদ্ধি করা এবং প্রত্যেক নারীকে দেবীমূর্তিজ্ঞানে শ্রদ্ধা করাই মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা। এই জন্যই দুর্গাপূজাতে কুমারীপূজার বিধি। প্রতিমাতেই দেবীর আবির্ভাব চিন্তা করা যেমন আবশ্যক, নারীমূর্তিতে দেবীর প্রকাশ অনুধ্যান করাও তেমনি কর্তব্য।


Print