ভাগুরী মুনির প্রশ্নে মার্কণ্ডেয় মুনি।
দেবীর মাহাত্ম্য-কথা বলেন আপনি।।
সূর্য্যপুত্র সার্বণির যাহা পরিচয়।
খ্যাত হ'য়ে আছে এই চরাচরময়।।
উদ্ভব কাহিনী তার বর্ণিব এখন।
অবধান কর তাহা হ'য়ে একমন।।
দেবীর কৃপায় যবে সূর্য্যের তনয়।
আপনিই মন্বন্তর অধিপতি হয়।।
মর্ত্ত্যের শাসনকারী মনু যে তখন।
সে সময় নৃপ নাম সুরথ রাজন্।।
চৈত্রবংশে জন্ম তার মহাবীর্য্যবান।
প্রজাপুঞ্জে পালিতেন সন্তান সমান।।
কিরাতের অধিপতি দারুণ দুর্জ্জয়।
কোল হত্যাকারী তারা নিষ্ঠুরতাময়।।
তাহাদের সঙ্গে নৃপ করিল সমর।
অত্যন্ত প্রবল রাজা সমরে তৎপর।।
তথাপি যে দৈববশে বিপত্তি উদয়।
সহজে রাজনে তারা কৈল পরাজয়।।
পলাইয়া নিজরাজ্যে আসিল নৃপতি।
অবরোধে তাঁর রাজ্য শত্রু শীঘ্রগতি।।
আক্রমিল চতুর্দ্দিক, দুর্ব্বল রাজন্।
ভাবিয়া হরিল বিত্ত রাজমন্ত্রিগণ।।
দুঃখানলে দগ্ধ রাজা রাজ্য-বিতাড়িত।
মৃগয়ার ছলে হন বনে উপনীত।।
গহন অরণ্যে দেখে বিস্ময়ে নৃপতি।
পবিত্র আশ্রম এক তাহার সংহতি।।
হিংস্র শ্বাপদের দল হিংসা তিরোহিত।
শান্তমনে ভ্রমিতেছে শান্ত সমাহিত।।
মুনি শিষ্যগণ বসি করে সামগান।
হেরিয়া বিস্মিত রাজা পুলকিত প্রাণ।।
মেধসমুনির সেই প্রধান আশ্রমে।
অতিথ্য লভিল রাজা পরম আরামে।।
তারপর ইতস্ততঃ ঘুরিতে ঘুরিতে।
দুর্ব্বিষহ চিন্তা জাগে রাজার মনেতে।।
মায়ার অধীন হ'য়ে আমার হৃদয়।
যা ত্যজিনু তাতে কেন দুঃখ উপজয়।।
পরিত্যক্ত রাজ্য মোর ল'য়ে শত্রুগণ।
ভোগ করিতেছে সুখে আনন্দে মগন।।
প্রজাপুঞ্জ শত্রুগণে তুষিছে এখন।
ভৃত্যগণ বৈরিকুলে করিছে তোষণ।।
কষ্টার্জ্জিত বিত্তরাশি শত্রু ভোগ করে।
মত্ত হ'য়ে আছে তারা কত পাপাচারে।।
ভাবিতে লাগিল নৃপ দুঃখিত অন্তর।
আশ্রম-সমীপে রাজা আসে অতঃপর।।
হেরিল সে বৈশ্য এক শোকাকল অতি।
দাঁড়ায়ে রয়েছে সেথা বিষণ্ন মুরতি।।
দেখিয়া তাহারে নৃপ বিস্ময়েতে কন।
কেবা তুমি কিবা হেতু হেতা আগমন।।
শোকাকুল দেখি তোমা কিসের কারণ।
ভাবিতেছি বুঝি কিছু হ’ল অঘটন।।
পীড়াপীড়ি করে রাজা বৈশ্য কহে তবে।
ধনমদে মত্ত মোরা দ্বারা পুত্র সবে।।
ধনলোভে অন্ধ তারা স্বার্থেতে মগন।
নির্দ্দয় হইয়া মোরা কৈল বিতাড়ন।।
সমাধি আমার নাম বৈশ্যের তনয়।
এত দুঃখ দিল তারা তবুও তন্ময়।।
মায়ায় আবদ্ধ জীব বিশ্ব-চরাচরে।
সদা চিন্তি তাহাদের কল্যাণের তরে।।
কি করিছে কি ভাবে যে রহিয়াছে তারা।
প্রাণাধিক পুত্রগণ প্রাণাধিকা দারা।।
কহিল বিস্ময়ে তবে সুরথ নৃপতি।
এত দুঃখ দিল তারা অতি দুষ্টমতি।।
তবু তাহাদের কথা চিন্ত সর্ব্বক্ষণ।
ভাবিতে বিস্ময় লাগে অপূর্ব্ব কথন।।
এত যদি নৃপবর বৈশ্যেরে কহিল।
মেধস মুনির কাছে উপনীত হ’ল।।
চরণ বন্দিয়া বসে তাহার সংহতি।
ভক্তিভরে পদপ্রান্তে জানায়ে প্রণতি।।
প্রশ্ন কিছু জাগিয়াছে অন্তরে মোদের।
সংসারের অভিজ্ঞতা জন্মিয়াছে ঢের।।
চিত্ত হ’ল অনায়ত্ত মায়াতে আবদ্ধ।
সর্ব্বজ্ঞান ব্যর্থ হয় ওহে সত্ত্বশুদ্ধ।।
রাজ্যের মায়াতে মুগ্ধ হইয়াছি আমি।।
আত্মীয়ের শোকে মগ্ন হইয়াছি স্বামী।।
দারা পুত্র বর্জ্জিয়াছে এ বৈশ্য রাজাকে।
তথাপি মরিছে দেখ আত্মীয়ের শোকে।।
মায়ার অধীন কেন চিত্ত মুনিবর।
বিবেক সত্ত্বেও কেন অজ্ঞান অন্তর।।
হাসিলেন শুনি মুনি কহেন তখন।
বিষয় ভেদেতে জ্ঞান জানিবে রাজন্।।
জগতের কত জীব চরাচরময়।
সকলে কি সমজ্ঞান লভিয়া জন্মায়।।
কোন জীব দিবা-অন্ধ রাত্রে অন্ধ কেহ।
দিবা রাত্র অন্ধ কেহ নাহিক সন্দেহ।।
শুধু যে মানুষ জ্ঞানী নহে তা রাজন্।
জ্ঞানী আছে বিশ্বমাঝে অন্য জীবগণ।।
স্নেহের আবর্ত্তে পড়ি যত জ্ঞানীজন।
জ্ঞানের অজ্ঞান হয় দেখ সর্ব্বক্ষণ।।
মহামায়া মহাচক্র করিয়া বিস্তার।
আবর্ত্তেন সর্ব্বজীবে হের নিরন্তর।।
কঠিন এ মায়া রাজা বিপুলা ধরায়।
বিধি বিষ্ণু এ মায়ার অন্ত নাহি পায়।।
হরিনেত্রে যোগনিদ্রা রাজে মহামায়া।
কপটে ফেলেন দেবী স্নেহের প্রচ্ছায়া।।
শুনি সেই কথা তবে নৃপ তাঁরে কয়।
শুনি মহামায়া কথা জন্মিল বিস্ময়।।
জন্মের বৃত্তান্ত তার কহ মহামুনি।
জাগে কৌতুহল আজি কহ মোরে শুনি।।
কহিলেন মুনি তবে শুনহ রাজন্।
কহিব বৃত্তান্ত তার শোন দিয়া মন।।
জগৎ-জননী তিনি নিত্যরূপা মাতা।
দেবত্রাণ হেতু দেবী বিশ্বে সমুদ্ভূতা।।
একার্ণব হয়েছিল এ বিশ্ব যখন।
বিষ্ণুনেত্রে যোগনিদ্রা রূপে তিনি রণ।
বিষ্ণুকর্ণমল হ'তে দুষ্ট দৈত্যদ্বয়।
মধু ও কৈটভ জনম লভয়।।
বিষ্ণুনাভিপদ্ম মাঝে ব্রহ্মারে হেরিয়া।
বিনাশিতে দৈত্যদ্বয় যাইল ছুটিয়া।।
যোগনিদ্রা অভিভূত শ্রীহরি তখন।
নিদ্রারূপে মহামায়া বিষ্ণু নেত্রাসন।।
অতএব আতঙ্কিত পদ্মযোনি তবে।
লাগিল তুষ্টিতে তাঁরে ভক্তিভরে স্তবে।
তুমি স্বাহা তুমি স্বধা দেবী মহামায়া।
অভাজনে এ সঙ্কটে দেহ পদছায়া।।
সাবিত্রীরূপিণী তুম সুধা-স্বরূপিণী।
বিদ্যা তুমি বুদ্ধি তুমি সঙ্কটে তারিণী।।
মহাস্মৃতি মহাবিদ্যা তুমি শ্রীঈশ্বরী।
কালরাত্রি মহারাত্রি তুমি মহেশ্বরী।।
হৃৎশক্তি আধার তুমি চক্রিণী গদিণী।
মায়াময়ী মহাময়ী করুণারূপিণী।।
মহালক্ষ্মী মহাদেবী তুমি সৌম্যতরা।
জগৎ ধারিণী তুমি, তুমি মা অপরা।।
জগৎপ্রসূতি মাতা কল্যাণকারিণী।
শত্রুঘ্না জননী তুমি শত্রুবিনাশিনী।।
স্তব তব করি মাগো কোথায় শকতি।
রক্ষা কর রক্ষাময়ী মোরে শীঘ্রগতি।।
মোহমুগ্ধ কর দৈত্যে বিনিদ্র হরিরে।
বুদ্ধি দেহ শ্রীবিষ্ণুরে বধিতে অরিরে।।
তুষ্টলাভ করি তবে জগৎ-জননী।
শ্রীবিষ্ণুকে ত্যজিলেন দেবী নারায়ণী।
যোগনিদ্রা অন্তে জাগে দেব জনার্দ্দন।
দৃষ্টির গোচরে দৈত্য পড়িলে তখন।।
গ্রাসিতে ব্রহ্মারে দেখি দৈত্যেরা উদ্যত।
শয্যা ছেড়ে উঠিলেন বিষ্ণু ত্বরান্বিত।।
মহাহব শরু হ’ল অতীব ভীষণ।
মধু ও কৈটভ দৈত্য করে মহারণ।।
পঞ্চ সহস্র বৎসর চলে যুদ্ধ তবে।
মদমত্ত হস্তিযুথ যুঝে মহাহবে।।
মায়ার প্রভাবে হত বুদ্ধি দৈত্যদ্বয়।
কহিল বিষ্ণুরে ওহে যাহা মনে লয়।।
প্রার্থ বর মম পাশে দানিব এখনি।
আমাদের কাছে তোমা ভক্ত ব'লে গণি।।
কহিল শ্রীবিষ্ণু তবে তুষ্ট যদি উভে।
আমার নিকটে উভে বধ্য হও তবে।।
চতুর্দ্দিক জলমগ্ন দেখি দুষ্টমতি।
দৈত্যদ্বয় বলে তবে বধ শীঘ্রগতি।।
কিন্তু এ সত্ত আছে শুন মহাশয়।
না বধিতে পাবে তুমি যথা জল লয়।।
ধূর্ত্তবুদ্ধি দৈত্যদ্বয় মনে মনে ভাবে।
জলপূর্ণ বসুন্ধরা কেমনে সম্ভবে।।
তথাস্তু বলিয়া বিষ্ণু জানু ’পরে টানি।
দুই দৈত্য চক্রে ছিন্ন করেন তখনি।।
মেধস বলেন কহি অপূর্ব্ব আখ্যান।
শুনিলে সকলি উভে মহা ভাগ্যবান।।
ব্রহ্মার স্তবেতে দেবী সৃজিলেন কায়া।
বহু মূর্ত্তি ধরিলেন দেবী মহামায়া।।
কহি আমি পুনর্ব্বার সে সব আখ্যান।
মায়া হবে অন্তর্হিত শুন ভাগব্যবান।
ইতি মধু-কৈটভ বধ। |