“চণ্ড-মুণ্ড হত” এই শুনিয়া সংবাদ।
ক্রোধে শুম্ভ ছাড়িলেক ঘোরতর নাদ।।
সকল অসুর সৈন্যে ত্বরিতে ডাকিয়া।
কহিল কুপিত শুম্ভ ভীষণ গর্জ্জিয়া।।
রণসাজে সাজ সবে দিতিজ সেনানী।
করে এত সৈন্যক্ষয় সামান্যা রমণী।।
যেথা যত সৈন্য আছে সাজহ সত্বর।
করহ শত্রুর সাথে প্রচণ্ড সমর।।
কালকেয় আদি যত আছে দৈত্যগণ।
শস্ত্রকরে এ সমরে করহ গমন।।
যাউক চতুরশীতি কম্বুকুলে জাত।
সবার শকতি আজ হোক প্রতিভাত।।
মহাবীর্য্য কুলোদ্ভব যোদ্ধৃগণ যাক।
মহারণে ধৃষ্টা নারী শিক্ষাআজ পাক।।
ধৌম্রকুলজাত যত দিতিজকুমার।
দুষ্টারমণীরে কর সমূলে সংহার।।
এই আজ্ঞা দিয়া তবে রণেতে যাইল।
সহস্র সহস্র সৈন্য সঙ্গেতে চলিল।।
দুরাগত সৈন্যে হেরি দেবী হুঙ্কারিল।
বিপুল শব্দেতে দেবী ধনু টঙ্কারিল।।
দেবীর বাহন করে ভীষণ গর্জ্জন।
শঙ্খ ঘণ্টা রবে দেবী তুলিল স্বনন।।
বিলোল রসনা কালী নাদিল প্রচুর।
সর্ব্বশব্দ অতিক্রমি গেল সুরপুর।।
মাতিল প্রচণ্ড রণে দেবী দৈত্যগণ।।
ঘন ঘন হাঁকে ঘোর সুরনিসূদন।।
সহসা অপূর্ব্ব দীপ্তি অম্বর ভাস্বর।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর প্রভৃতি অমর।।
শূন্যে মার্গে আবির্ভূত অতি মনোহর।
তা সবার দেহ হতে অপূর্ব্ব সুন্দর।।
বাহিরিল মহাতেজ দেবী চণ্ডিকায়।
প্রবেশিল শীগ্রগতি অপূর্ব্ব লীলায়।।
নিত্যরূপা শক্তিময়ী মহাশক্তি ধরে।
ক্ষেপিল মহাস্ত্র কত দারুণ সমরে।।
মরাল রথেতে চড়ি ব্রহ্মাণী শকতি।
যুঝিবার করে ক্ষেত্রে আসে শীঘ্রগতি।।
মাহেশ্বরী আইলেন বৃষভবাহনা।
ধাইলেন মহারণে বিদ্যুৎ-গমনা।।
দেবীর কৌমারী শক্তি ময়ূর-আরূঢ়া।
আইলেন অস্ত্রসহ উগ্র ক্রোধাতুরা।।
গরুড়বাহিনী দেবী বৈষ্ণবী-শকতি।
শঙ্খ চক্র গদা লয়ে যুঝে শীঘ্রগতি।।
বারাহীরূপেতে দেবী সমরে ভীষণ।
নারসিংহীরূপে দেবী ভীম প্রভঞ্জন।।
বজ্র করে মাহেন্দ্রাণী গজারূঢ়া রণে।
সহস্রনয়না দেবী যুঝে প্রাণপণে।।
মহাদেব কহিলেন দেবী চণ্ডিকায়।
হনন করহ শক্র দেবী অচিরায়।।
দেবী দেহ হতে পরে জনম লভিল।
দেবী চণ্ডিকার শক্তি ভীমা হুঙ্কারিল।।
জটাজাল সুবিস্তৃত দেবতা ঈশানে।
কহিলেন দেবী তবে অসুর-সদনে।।
যাও শীঘ্রগতি দেব দূতরূপে তুমি।
কাহবে তাদের গিয়া যাহা কহি আমি।
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব দৈত্য দাওরে ফিরায়ে।
বাঁচিতে থাকিলে ইচ্ছা সাঙ্গোপাঙ্গ লয়ে।।
পাতালে প্রবেশ করি তথাদৈত্যরায়।
রাজ্যসুখ ভুঞ্জ সুখে যদি ইচ্ছা লয়।।
তবে যদি পুনরায় যুদ্ধে থাকে মতি।
আমার শিবার খাদ্য হইবে সমপ্রতি।।
শিবে দূত নিয়োজিয়া দেবী ধরাধামে।
খ্যাত হইলা মহানাম শিবদূতী নামে।।
শুনিয়া ভারতী সব রুষিল দানব।
অগণিত শর বর্ষে প্রচণ্ড আহব।।
দেবীর উপরে যত অমরারিগণ।
নানা অস্ত্র বিভীষণ করে বরিষণ।।
অপূর্ব্ব কৌশলে দেবী সে সব কাটিয়া।
মহা মহা অস্ত্র সব ফেলে বিচুর্ণিয়া।।
রণক্ষেত্রে মহাকালী করালবদনা।
ত্রিশূল অস্ত্রেতে যুঝে রুদ্রা বিভীষণা।।
খট্বাঙ্গ প্রহার করে দৈত্য বার বার।
বিমর্দ্দিত দৈত্যকুল কে নিবারে আর।।
কমণ্ডলু জল ক্ষেপি দেবী সে ব্রহ্মাণী।
হতবীর্য্য করিলেক অসুর-সেনানী।।
ত্রিশূল আঘাত হানে দেবী মাহেশ্বরী।
করিছে সংহার যজ্ঞ জগত-ঈশ্বরী।।
কৌমারী নাশিল দৈত্য কত অগণন।
রণক্ষেত্রে শোণিতের বহে প্রস্রবণ।।
বারাহী দশনাঘাতে ছিন্ন করে দেহ।
পদতলে কেহ পড়ে বিমদ্দিত কেহ।।
নারসিংহী হানে দৈত্যে সুতীব্র নখরে।
অতিষ্ঠ অসুরগণে জয় জয় করে।।
রণে ভঙ্গ দেয় দৈত্য ভীষণ আহবে।
প্রাণভয়ে পলাইছে অমরারি সবে।।
হেরিয়া দৈত্যের দশা রক্তবীজ আসে।
ভীষণদর্শন দৈত্য হাসে অট্টহাসে।।
ভীষণ মায়াবী দৈত্য অপূর্ব্ব কথন।
সমরে বধিতে তারে আছে কোন্ জন।।
একবিন্দু রক্ত যদি পড়ে ধরা’ পরে।
চক্ষুর পলকে দৈত্য উঠিবে সত্বরে।।
দারুণ দুর্দ্ধর্ষ বীর সমরে ভীষণ।
মহাবলে যুঝে যেন ভীম প্রভঞ্জন।।
গদালয়ে ধায় বীর করে মহারণ।
বীরদর্পে সিংহনাদ ছাড়ে ঘন ঘন।।
ঐন্দ্রী লয়ে মহাব্রজ নিক্ষেপিল শূরে।
অপূর্ব্ব কৌশলে দৈত্য ফেলে তাহা দূরে।।
কুলিশে হইল ক্ষত, দেহ হতে তার।
পৃথ্বিতলে পড়ে উষ্ণ শোণিতের ধার।।
শোণিত হইতে জন্ম বীর শত শত।
সমবীর্য্য তারা সবে যুঝে নানা মত।।
মাতৃগণ সহ যুঝে ভীষণ আহবে।
নানা অস্ত্রে প্রহারিল দেবীগণ সবে।।
দারুণ রুষিয়া দেবী ভীম বজ্র হানে।
পুনর্ব্বার রক্তস্রোত ধরাধামে নামে।
পুনশ্চ সহস্র বীর জনম লভিল।
দেখিয়া জননীগণ ভীষণ রুষিল।।
নারিল বধিতে দৈত্য ক্ষণে ক্ষণে বাড়ে।
যুঝিছে ভীষণ দৈত্য দারুণ সমরে।।
কৌমারী হানিছে অস্ত্র মন্ত্রপূত বারি।
ব্রহ্মানী ক্ষেপিল কত বর্ণিতে না পারি।।
মাহেশ্বরী রক্তবীজে হানে মহাশূল।
তথাপি না মরে দৈত্য সংগ্রামে অতুল।।
এই ছিন্ন হয় শির এই দৈত্য ওঠে।
রণেতে পড়িলা দেবী বিষম সঙ্কটে।।
হানিতে লাগিল বীর গদা লয়ে হাতে।
কুটিল ভয়াল রণ না পারি বর্ণিতে।।
তাহা দেখি দেবগণে ভীতি উপজয়।
কেমনে মরিবে দৈত্য সকলে চিন্তয়।।
দেখি দেবতার ভীতি চণ্ডিকা তখন।
চামুণ্ডারে কহিলেন মধুর বচন।।
চামুণ্ডে বদন তব আজি বিস্তারিয়া।
দারুণ দৈত্যের রক্ত ফেলহ গ্রাসিয়া।।
যখন হানিব অস্ত্র পড়িলে শোণিত।
তব লোল রসনায় পীবহ ত্বরিত।।
করিলে শোণিত পান শেষ বিন্দু তার।
অচিরে দারুণ দৈত্যে করিব সংহার।।
এত যদি দেবী তারে কহিল তখন।
করালবদনা কালী করিল গমন।।
এত বলি সে চণ্ডিকা শূলের প্রহারে।
চকিত দুর্দ্ধর্ষ দৈত্যে হানে খরতরে।।
কত রক্ত বাহিরিল তার দেহ হতে।
করালবদনা কালী গ্রাসিল চকিতে।।
লক্ষ্য নাহি অসুরের করে মহারণ।
অবিরত হয় তার রক্ত নির্গমন।।
দৈত্যের আনন হ’তে শোণিত ধারায়।
চামুণ্ডা রূপেতে কালী সকলি ভক্ষয়।।
দরদর ধারে রক্ত বহে প্রস্রবণ।
পান করে দেবী তাহা লীলায় তখন।।
এই ভাবে রক্তবীজ হইয়া নিরক্ত।
দেবীকরে মহাবীর হইলেন হত।।
এইরূপে রক্তবীজ যখন দুর্ব্বল।
অস্ত্রাঘাতে মহাদেবী পড়িল ভূতল।।
পড়িল ভূতলে যবে তিরোহিত প্রাণ।
পুষ্পবৃষ্টি করে সুর গায় মাতৃগান।।
-ইতি রক্তবীজ বধ। |