ঋষি কহিলেন শোন সুরথ নৃপতি।
মহামায়া-চরিত্র যে কহিব সমপ্রতি।।
পুরাকালে মহীতলে ছিল দৈত্যদ্বয়।
শুম্ভ ও নিশুম্ভ নাম দারুণ দুর্জ্জয়।।
আপনার শক্তিমদে বুদ্ধি তিরোহিত।
অজ্ঞ দৈত্যদ্বয় যজ্ঞভাগ আগে নিত।।
সূর্য্যে করে দুইজনে প্রভুত্ব বিস্তার।
সংস্থাপিল স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্র-অধিকার।।
কুবেরের আধিপত্য যমের শকতি।
অধিকার ক'রে নিল দৈত্য দুষ্টমতি।।
অগ্নির ক্ষমতা হরি পবন সমৃদ্ধি।
সহজে করিল দৈত্য অধিকার বৃদ্ধি।।
সকল অমরগণে কৈল পরাজিত।
স্বর্গরাজ্য হ’তে তারা হয় বিতাড়িত।।
বিপন্নাত্রে দেবী স্মৃতি উদিল যেমতি।
হিমালয় নগ ’পরে যায় শীঘ্রগতি।।
তথা গিয়া ভক্তিভরে অমর সকল।
দেবীর বন্দনা সত্ততি আরম্ভ করিল।।
বিপন্ন হইয়া মোরা ডাকি গো জননি।
স্মৃতিমাত্রে দেব-সন্নিকটে এস তুমি।।
প্রণমি তোমায় দেবী ভক্তিযুত মনে।
ত্রাণকর এ বিপদে ওগো সুলোচনে।।
নমি মা প্রকৃতি তোমা নমি মাগো ভদ্রে।
নমি নিত্য হররমা নমি মাগো রৌদ্রে।।
সুকল্যাণী শোভনা মা করি তোমা স্তব।
দৈত্য হতে রক্ষা দেবী আমা দেবসব।।
অপরূপে নমি তোমা মহালক্ষ্মী তুমি।
সর্ব্বার্থসাধিকে মাতঃ তোমারে প্রণমি।।
বিষ্ণুমায়া তুমি দুর্গে দুর্গতি নাশিনী।
তুমি মা প্রতিষ্ঠা কীর্ত্তি সকল কারিণী।।
শক্তিরূপা মহাদেবী তুমি মহামায়া।
অরিকুল নাশ মাতঃ, দেহ পদছায়া।।
সর্ব্বভূতে আত্মা তুমি, তুমি মা চেতনা।
সর্ব্বকালে তুমি শুভ কল্যাণী শোভনা।।
সর্ব্বজীবে তুমি বুদ্ধি ক্ষুধারূপে তুমি।
কায়াসাথে ছায়া রূপা তোমারে প্রণমি।।
প্রাণিদেহে তুমি নিদ্রা সর্ব্বজীবে শক্তি।
সঙ্কটেতে পরিত্রাহী বন্ধনেতে মুক্তি।।
তুমি তৃষ্ণা তুমি তৃপ্তি তুমি সর্ব্বেশ্বরী।
গললগ্নবাসে মোরা প্রণিপাত করি।।
ক্ষান্তিরূপা অচিন্তিতা চিন্তাময়ী মাতঃ।
দয়ারূপা দয়া কর করি প্রণিপাত।।
তুমি শান্তি সর্ব্বলোকে সুষমা সুন্দরী।
ভূতবৃন্দে তুমি শ্রদ্ধা জগৎ-ঈশ্বরী।।
তুমি কান্তি কান্তিময়ী সূর্য্যতেজোৎপলা।
রৌদ্র দাহ তুমি মাগো তমিস্র-কুন্তলা।।
তুমি ঋদ্ধি তুমি সিদ্ধি ত্রিগুণাধারিণী।
সঙ্কটে ও ত্রাসে তুমি বিপদবারিণী।
রিপুদল নিবারিণী তুষ্টিরূপা মাতা।
তেজোরশ্মিময় দেহ অনল উদগাতা।।
তুমি মা অচিন্ত্যরূপা চরাচরময়।
সমগ্রে বিস্তার তব অচিন্ত্য অক্ষয়।।
চিতিরূপে পরিব্যপ্ত বিশ্ব চরাচর।
প্রণমি তোমায় মোরা অমর-নিকর।।
সুরেন্দ্র-সেবিতা মাতা বহু পূজ্যা তুমি।
তোমার চরণপদ্মে আমরা প্রণমি।।
উদ্ধত দৈত্যের তেজে মোরা সন্তার্পিত।
রক্ষা কর ত্রাণকর্ত্রী মোরা অনুগত।।
শ্রীচরণে প্রণিপাত করি মোরা সবে।
সংহার করহ দৈত্যে ভীষণ আহবে।।
এই মত স্তব যদি করে দেবগণ।
ছলনায় দেবী তবে করেন গমন।।
সিনান করিতে স্নিগ্ধ জাহ্নবীর কূলে।
গজেন্দ্রগমনে দেবী হিমালয়-মূলে।।
ছলে দেবী জিজ্ঞাসেন হে অমরগণ।
এখানে বসিয়া কর কাহার স্তবন।।
দেবকোষ হতে তাঁর শিবা সমুদ্ভূতা।
“করিছে আমার স্তব” বলে এই কথা।।
দেবকোষ হতে দেবী নিঃসৃতা হইল।
সেই হেতু কৌষিকী নাম দেবীর রহিল।।
কোষ-বিনির্গত দেবী পার্ব্বতী তখন।
হইলেন কৃষ্ণকায়া ভীম দরশন।।
মহাঘোরে কৃষ্ণমূর্ত্তি তাই কালী নাম।
প্রচারিত হইল দেখি সর্ব্ব বিশ্বধাম।।
ধরির অম্বিকা মূর্ত্তি অপূর্ব্ব সুন্দর।
শুম্ভভৃত্য চণ্ড মুণ্ড দেখি মনোহর।।
রূপবতী কন্যা এক চলিল ত্বরায়।
কহিল শুম্ভের কাছে বৃত্তান্ত সভায়।।
মহারাজ দেখিয়াছি হিম-অদ্রিতলে।
সুন্দরী কন্যকা এক বৈসে অবহেলে।।
অপূর্ব্ব তাহার রূপ না পারি বর্ণিতে।
হিমালয় উদ্ভাসিত তাহার জ্যোতিতে।।
রত্ন আদি গজ অশ্ব সকলি তোমার।
সূর্য্য যম সকলেই তব অধিকার।।
বাসবের ঐরাবত উচ্চৈঃশ্রবা হয়।
তোমার সম্মত্তি এবে ভুঞ্জ অচিরায়।।
প্রজাপতি ভয়ে দিল হংস উপহার।
কুবেরের মহাপদ্ম সম্পত্তি তোমার।।
বরুণের ছত্র এবে শোভে তব মাথে।
পঙ্কজ মালিকা শোভে তোমার কণ্ঠেতে।।
সুন্দর সুদৃশ্য রথ প্রজাপতি-ঘরে।
বর্ত্তমানে তব গৃহে সৌন্দর্য্য বিতরে।।
বহ্নি দিল শুদ্ধ সত্ত্ব বসন যুগল।
রত্নাকর রত্ন দিল আতঙ্কে বিহ্বল।।
তবে যদি মহৈশ্বর্য্যে বিরাজ রাজন্।
কেন করিবে না সেই স্ত্রীরত্ন গ্রহণ।।
শুনিয়া তাদের বাক্য শুম্ভ ভাবে মন।
অবশ্য কবির এই স্ত্রীরত্ন গ্রহণ।।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, আমি মহাবীর।
গ্রহণ করিব এরে এই হল স্থির।।
শুম্ভের আদেশে দূত হইল প্রেরিত।
সুগ্রীব তথায় গিয়া হৈল উপনীত।।
যথায় আছেন বসি দেবী বরাননে।
কহিল শুম্ভের দূত মধুর বচনে।।
শুন দেবি! শুম্ভনামে দৈত্য-অধিপতি।
তোমারে ইচ্ছিল দেবী চল শীঘ্রগতি।।
তোমারে আনিতে মোরে করিল প্রেরণ।
চলহ আমার সাথে যদি লয় মন।।
তিনি এবে স্বর্গপতি অতুল ঐশ্বর্য্য।
সর্ব্বদেব পরাভূত তিনি মহাবীর্র্য্য।।
তার পত্নীরূপে দেবী সুখে কর বাস।
সুশোভন স্বর্গরাজ্যে যদি অভিলাষ।।
শুনিয়া সুগ্রীব-বাক্য দেবী মহেশ্বরী।
কুপিতা হইল দেবী প্রকাশ না করি।।
ঈষৎ হাসিয়া তবে দেবী বরাননে।
কহিতে লাগিল তারে কোমল বচনে।।
“সত্যবাণী” কহিয়াছ তুমি ইহা জানি।
শুম্ভ ও নিশুম্ভ কথা আমিও বাখানি।।
কিন্তু এক প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ রহি আমি।
রণে যে হারাবে মোরে সেই মোর স্বামী।।
অল্পবুদ্ধি নারী আমি ভীষণ শপথ।
এখন পালিতে হবে নাহি অন্য পথ।।
অগত্যা আসুন শুম্ভ ভীষণ আকার।
অথবা তাঁহার ভ্রাতা সর্ব্বগুণাধার।।
আমারে করিয়া জয় করুন গ্রহণ।
জানাতে বৃত্তান্ত দূত করহ গমন।।
দূত বলে দেবী দর্প অতিশয়।
সমরে তিষ্টিবে হেন কোনজন রয়।।
দেবজয়ী দৈত্যবর দারুণ দুর্দ্ধর।
যুঝিবে তাহার সনে পরিহার কর।।
তোমার এ বাক্য দেবী হাস্যাস্পদ হবে।
বৃথাই করিবে যুদ্ধ আসন্ন আহবে।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ হৈল পরাজিত।
ত্রিলোকের শ্রেষ্ঠ তিনি অক্ষয় অজিত।।
হেন শুম্ভ নিশুম্ভের সহিত রমণী।
একা রণে আশা তব চল তুমি ধনি।।
নহিলে দারুণ দৈত্য কেশ আকর্ষিয়া।
লয়ে যাবে স্বর্গপুরে বন্দিনী করিয়া।।
দেবী বলে কি করিব প্রতিজ্ঞা আমার।
পালিতে হইবে সত্য ভাঙ্গি কি প্রকার।।
যাও দূত শীঘ্র তুমি দৈত্যবর পাশে।
কহিবে বৃত্তান্ত সব তাঁহার সকাশে।।
করিবেন তিনি তাঁর যাহা মনে লয়।
অপেক্ষা করিব আমি জানিও নিশ্চয়।।
-ইতি দেবী দূত কথা। |