Increase Reset Decrease

মহাবিদ্যা - ষোড়শী

তারার পরে যিনি মহাদেবকে দর্শন দিলেন তিনি ষোড়শী। ইনি ত্রিপুরসুন্দরী, ত্রিপুরা ভৈরবী, রাজরাজেশ্বরী, ত্রিকুটাদেবী, শ্রীবিদ্যা। তন্ত্রশাস্ত্রমতে ইনি অপরূপা দিব্য সৌন্দর্যের অধিশ্বরী। ইনি রজঃগুণ প্রধানা ও সত্ত্বগুণাত্মিকা-এঁর রূপ মহাদেবের দৃষ্টির সামনে ধরা দিয়েছিল এক সুন্দরী ষোড়শী যুবতীর মূর্তিতে। এর ধ্যানমূর্তি, “বালার্কমণ্ডলাভাসাং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনাম্ পাশাঙ্কুশ বরাভীতি ধায়ন্তীং শিবাংশ্রয়ে।” উদীয়মান সূর্যের মতো রক্তবর্ণ যাঁর গায়ের রং, চতুর্ভুজা, ত্রিনয়না, চারহাতে পাশ, অঙ্কুশ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে আছেন যিনি সেই শিবানীই সকলের আশ্রয়। তিনি বসে আছেন একটি রক্তপদ্মের ওপর। সেই পদ্মটি আবার এক অর্ধশায়িত মহাদেবের নাভি থেকে উঠে এসেছে। এই বিগ্রহের তিনটি স্তর। সর্বনিম্ন স্তরে একসারি দেবতা করজোড়ে ধ্যানরত। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-পঞ্চানন ও রুদ্রদেব। নিজেরই শরীরজাত পদ্মাসনে দেবীকে উপবিষ্টা দেখে ও তাঁর পদতলে ব্রহ্মাদি পঞ্চদেবতাকে স্তুতিরত দেখে শিব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এই ষোড়শীর সৃষ্টি সম্পর্কে নারদপঞ্চরাত্রে এক অপূর্ব কাহিনী আছে। ইনি জগৎকে শ্রী দান করেন তাই ইনি শ্রীবিদ্যা মহাদেবী ত্রিগুণাতীতা। তাই তাঁর নাম ষোড়শী।

কীভাবে মহামায়া কালিকা সৌন্দর্যময়ী হয়েছিলেন তার বর্ণনায় বলা হচ্ছে-বলছেন, একসময় মহাদেব যখন কৈলাসে বসবাস করছেন তাঁর ঘরণী অসিতা মহাদেবীকে নিয়ে, সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র কোনো কারনে অপ্সরাদের পাঠালেন মহাদেবের কাছে তাঁর বন্দনা করবার জন্য। যোগীশ্বর, যোগেশ্বর মহাদেব ইন্দ্রের এই কীর্তি বুঝতে পেরে অপ্সরাদের বললেন, “পুরুষের অতিথি পুরুষ, আর স্ত্রীলোক স্ত্রীলোকের অতিথি। এই জন্য তোমরা আমার গৃহিণী দেবী কালিকার কাছে যাও।” এই বলে তাদের সঙ্গে করে অন্দরমহলে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করে এদের পরিচয় দিলেন। মহাদেবী এইভাবে বাইরের লোকের সামনে তাঁকে কালী বলে ডাকায় খুবই ব্যথিত হলেন। ঘরে তাঁকে কালো রং-এর জন্য কালী বলা সহ্য করা যায়, কিন্তু তাই বলে বাইরের লোকের সামনে এই ভাবে কালী বলায় তিনি খুবই অপমানিত বোধ করে ভাবলেন, ‘আমি তপস্যা করে এই কালো রূপের আবরণ সরিয়ে শুদ্ধ গৌরী রূপ ধারণ করে মহাদেবের চোখ ধাঁধিয়ে দেব।’ এই ভেবে তিনি অন্তর্ধান করলেন।

মহাদেব কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেবীকে দেখতে না পেয়ে সেইখানেই বসে তাঁর ধ্যান করতে লাগলেন। এই সময়ে সব গোলমাল পাকানো নারদ সেখানে এসে হাজির হলেন। নারদ একথা-সেকথার পর দেবী কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন “দেবী আমাকে ছেড়ে অভিমান করে কোথায় চলে গিয়েছেন।” নারদ এই কথা শুনে ঝগড়া লাগাবার একটা সূত্র পেয়ে মনে মনে খুব খুশি হয়ে ধ্যান করে জানতে পারলেন দেবী সুমেরু পর্বতের দিকে গিয়ে তপস্যা করছেন। নারদ শিবকে প্রণাম করে তখনই দেবীর তপস্যাস্থলে হাজির হয়ে তাঁকে প্রণাম করে কুশল প্রশ্ন করলেন। দেবী তাঁকে পাল্টিয়ে জানতে চাইলেন, “আমাকে ছেড়ে মহাদেব কেমন আছেন? তিনি ভালো আছেন তো?” দূরে গেলেও পতির চিন্তাতে মহামায়া উদ্বিগ্নই ছিলেন। নারদ কিন্তু উল্টোসুর ধরলেন। তিনি বললেন-“আপনাকে ছেড়ে তিনি ভালোই আছেন। অন্য কোনো দেবীর চিন্তায় তিনি মগ্ন হয়ে আছেন। আপনি শিগ্গির সেখানে গিয়ে তাঁকে সামলান।” এই কথা শুনে দেবী দারুন রেগে গেলেন ও এক অপরূপা মূর্তি ধারণ করলেন, রাগে তাঁর সর্বাঙ্গ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। ত্রিলোকে এমন সুন্দরী আর নেই। সেই দিব্য সৌন্দর্যে শোভিতা হয়ে তিনি চললেন কৈলাসে। “দেখাচ্ছি তোমাকে, আমার চেয়ে আর বেশি সুন্দরী তুমি কাকে ভাবছ! ত্রিলোকে আর কেউ এমন পারে না।” এই দিব্য সৌন্দর্যে ত্রিজগৎ আলো করে মা এসে হাজির হলেন কৈলাসে ধ্যানরত শিবের কাছে। সেখানে তিনি গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন ধ্যানস্থ শিবের বুকে এক অনুপমা নারীমূর্তির ছায়া। এই দেখে মহাদেবী আরও রেগে গিয়ে শিবকে খুব নিন্দা করতে লাগলেন। “তুমি পত্নীর প্রতি অবিশ্বস্ত, ব্যভিচারী, অন্য রমণীর চিন্তায় মগ্ন। এই তোমার আমার সঙ্গে সম্পর্ক?” দেবীর এই অভিমানপূর্ণ রূঢ় ভাষায় মহাদেব ধ্যান ভেঙে মৃদু হেসে দেবীকে বললেন “আমি কোনো অন্যায় তো করিনি। কোনো বিশ্বাসের সীমাও লঙ্ঘন করিনি। তুমি শুধু শুধু কেন আমার ওপর রাগ করছ? একটু ভালো করে ছায়াটির দিকে লক্ষ্য কর আর নিজেকে দেখ। তাহলেই সব রহস্যের যবনিকাপাত হবে।” এই শিববাক্যে দেবী নিজের মূর্তির দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলেন শিবহৃদয়ে তাঁরই ছায়া মাত্র। নিশ্চিন্ত হলেন দেবী। তখন দেবী শিবকে প্রশ্ন করলেন, “আমার এই নতুন গৌরী মূর্তি, যার ছায়া তোমার হৃদয়ে তার পরিচয় কী হবে তুমিই বল? তখন শিব বললেন, “হে শিবে! তুমি ত্রিভুবনে শ্রেষ্ঠ রূপ ধরেছিলে, সেজন্য স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে তোমার তুলনা তুমিই হবে। তোমার নাম হবে ত্রিপুরসুন্দরী। তুমি হবে অটুটযৌবনা-সদা ষোড়শবর্ষীয়া, তাই তোমার নাম হবে ষোড়শী। আজ আমার হৃদয়ে তুমি তোমারই ছায়া দেখে ভীতা হয়েছিলে সেজন্য তিনলোকে তুমি ত্রিপুরভৈরবী বলে খ্যাত হবে। তুমি সর্বসৌন্দর্যময়ী, সকল ঐশ্বর্যের অধিশ্বরী, তাই তোমাকে সাধকেরা বলবেন রাজরাজেশ্বরী। তুমি জগতের সমস্ত বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাই তোমার নাম হবে শ্রীবিদ্যা।” শিববচনে প্রসন্না হয়ে দেবী পরমানন্দে কৈলাসে শিবসঙ্গে বিরাজ করতে লাগলেন।

Print