
কার্ত্তিকের বাহন
কার্ত্তিকের বাহন ময়ূর। কোনো কোনো মতে কুক্কুট বা মোরগও কার্ত্তিকের বাহন। বামনপুরাণের মতে দেবসেনাপত্যে অভিষিক্ত হওয়ার পর গরুড় কার্ত্তিককে বাহন হিসাবে ময়ূরকে প্রদান করেছিলেন। বরাহপুরাণের মতে ঐ সময় পিতা শিব কার্ত্তিকেয়কে ক্রীড়ার জন্য কুক্কুট উপহার দিয়েছিলেন। মহাভারতের মতে অগ্নিদেব এবং মৎস্যপুরাণের মতে বিশ্বকর্মা কার্ত্তিকেয়কে কুক্কুট উপহার দিয়েছিলেন। তবে মহাভারত ও পুরাণের বর্ণনায়, পুরাণের প্রতিমালক্ষণ-বিবৃতিতে, তন্ত্রের ধ্যানমন্ত্রে এবং প্রাচীন মুদ্রায় প্রধানত কার্ত্তিককে ময়ূরবাহনরূপেই দেখানো হয়েছে। এমনকি পূর্বোক্ত অথর্ববেদের পরিশিষ্ট স্কন্দযাগেও কার্ত্তিকের ময়ূরবাহনত্ব উল্লিখিত হয়েছে। কুক্কুট অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্ত্তিকের হস্তধৃতরূপেই বর্ণিত, যাতে বোঝা যায় কুক্কুট তরুন শিবপুত্রের একটি প্রিয় ক্রীড়নক। প্রাণিতত্ত্ববিদগণের মতে, ময়ূর ও কুক্কুট উভয়েই সমবর্গীয় পক্ষী। যাহোক, পরিবার-সমন্বিতা মহিষাসুরমর্দিনীর সঙ্গে কার্ত্তিককে আমরা ময়ূরবাহনরূপে দেখতে অভ্যস্ত। এমনকি মালয়েশিয়া এবং জাপানে কার্ত্তিকের যে মূর্তি ও মন্দির দেখা যায় সেখানেও তিনি ময়ূরবাহন।
প্রশ্ন : কেন কার্ত্তিক ময়ূরবাহন? ময়ূরের পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্ট্য-সৌন্দর্য, যৌবনদৃপ্ততা, বীর্য, যোদ্ধৃত্ব এবং প্রাতরুত্থান। সৌন্দর্য, যৌবনদৃৃপ্ততা, বীর্য, যোদ্ধৃত্ব জন্য ময়ূর পক্ষীকুলে নৃপতিতুল্য। ভারতের জাতীয় পক্ষীও ময়ূর। দেবীর চার সন্তানের মধ্যে কার্ত্তিকের সঙ্গে সর্বাংশেই তার সর্বাপেক্ষা বেশি সাদৃশ্য। দেবীর বাহন যেমন পশুরাজ, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের বাহন তেমনি পক্ষীরাজ। বিষধর সর্প ময়ূরের আক্রমণ-নৈপুণ্য এবং পরাক্রমে শুধু যে পর্যুদস্ত হয় তাই নয়, একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ময়ূরের কেকাধ্বনি নিশাবসানের সঙ্কেত ঘোষণা করে। তার প্রাতরুত্থান-অভ্যাস তার অনলসতা, অতন্দ্র সতর্কতা এবং জাড্যহীন তৎপরতার পরিচায়ক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ময়ূরের উল্লিখিত পাঁচটি বৈশিষ্ট্য কুক্কুটের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য।
সমগ্র ত্রিভুবনের সুরক্ষার দায়িত্ব যাঁর স্কন্ধে অর্পিত সেই স্কন্দ-কার্ত্তিকেয়ের বাহনের নিকট তো এই গুণগুলিই সর্বাগ্রে প্রকাশিত। আলস্য, তন্দ্রা, নিদ্রা, জড়তা, দীর্ঘসূত্রতা, অসতর্কতা ও অসাবধানতাকে নির্মমভাবে পদানত করতে না পারলে এবং যৌবনোচিত উদ্যম, যোদ্ধৃত্ব, বীর্য ও শক্তি প্রকাশ না করলে কি স্কন্দ-কার্ত্তিকেয় দেবসেনাপতির মর্যাদা লাভ করতে পারতেন, না ত্রিলোকজয়ী তারকাসুরকে পরাভূত ও বিনাশ করতে পারতেন? কী সংসারজীবনে, কী সাধন-জীবনে, কী কর্মজীবনে সার্থকতা নিহিত ঐ দুর্বলতাসমূহের দমনের এবং ঐ শক্তি প্রকাশের ওপর। ঐ দমনের পরাকাষ্ঠা, ঐ শক্তি প্রকাশ তাঁর জীবন ও কর্মে দেখিয়েছিলেন বলেই দেবাসুর সংগ্রামে স্কন্দ-কার্ত্তিকেয় চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করেছিলেন। ময়ূর বিষধর সর্পকুলকে ধ্বংস করে আমাদের জীবনকে নিরুদ্বেগ করে। কার্ত্তিকও সভ্যতার শত্র“ অসুরকুলকে ধ্বংস করে সভ্যতার পরিত্রাতার ভূমিকায় একদা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জগতের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কার্ত্তিকেয় ও তাঁর বাহন ময়ূরের গুণাবলীর তাৎপর্য আমাদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।
সর্পের মতো ক্রূর ও খল মানুষেরা সভ্যতার শত্র“। এই সুন্দর পৃথিবীকে তারা প্রতিমুহূর্তে তাদের বিষাক্ত উপস্থিতিতে কলুষিত করছে। তাদের অবস্থান পৃথিবীর বাসযোগ্যতাকে বিনষ্ট করছে। পৃথিবীকে এই সর্পস্বভাব মানুষের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হলে প্রয়োজন সর্পহন্তা ময়ূরের মতো বীর্য ও যোদ্ধৃত্ব। বস্তুত, সর্পস্বভাব যেমন প্রায় সকল মানুষের মধ্যেই কম-বেশি নিহিত, তেমনি নিহিত ময়ূরস্বভাবও। আমাদের অন্তরস্থিত সর্পস্বভাবকে খর্ব ও ধ্বংস করতে হবে আমাদের অন্তরস্থিত ময়ূরস্বভাবের উদ্বোধনের মাধ্যমে। ময়ূরের মধ্যে যেমন বীর্য ও যোদ্ধৃত্ব প্রকট, তেমনি প্রকট তার যৌবনদৃপ্ততা এবং সৌন্দর্য। যৌবনের ধর্মই হলো দুরতিক্রম্যকে অতিক্রমের উচ্চাভিলাষ, প্রতিবন্ধকের সম্মুখে নতিস্বীকারের প্রবল অনীহা। যৌবনের বৈশিষ্ট্য গতি-অধরাকে ধরার, দুর্লঙ্ঘ্যকে লঙ্ঘন করার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা। আর তার মধ্যেই নিহিত যৌবনের প্রকৃত সৌন্দর্য। জড়তা, তন্দ্রা, আলস্য, নিদ্রা প্রৌঢ়ত্বের লক্ষণ এবং বার্ধক্যের ধর্ম। যৌবনে যদি ঐগুলি দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে যৌবন রাহুগ্রস্ত হয়েছে, যৌবন তার সৌন্দর্য হারিয়েছে, কুশ্রীতা যৌবনকে গ্রাস করেছে। যৌবন এবং সৌন্দর্য যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পৃথিবীকে সর্পমুক্ত করা যেমন দুঃসাধ্য, তেমনি দুসাধ্য পৃথিবী থেকে স্বর্পস্বভাব মানুষকে বা মানুষের অন্তরস্থিত স্বর্পস্বভাবকে নির্মূল করা। কিন্তু যৌবনদৃপ্ত ময়ূর যেমন সর্প দেখলেই তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তীক্ষè চঞ্চু ও শাণিত নখরের আঘাতে তাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে, মানুষের মধ্যে যারা ময়ূরস্বভাব অথবা মানুষের মধ্যস্থিত ময়ূরস্বভাব তেমনি জগতের সর্পস্বভাব মানুষের অথবা মানুষের অন্তরস্থিত সর্পস্বভাবের সঙ্গে চিরন্তন সংগ্রামে লিপ্ত। এই সংগ্রামের মনোবৃত্তিই ময়ূরস্বভাব মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য।
ময়ূরের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য প্রাতরুত্থান। এটি তার স্বভাব। প্রাতরুত্থান স্বভাববিশিষ্ট ময়ূর নিদ্রালসতার কাছে আত্মসমর্পণ করে না। সভ্যতার স্থায়িত্ব, স্বাধীনতার স্থায়িত্ব নির্ভর করে মানুষের অনলস তৎপরতার ওপর। পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে হলে, পৃথিবীর বাসযোগ্যতা অটুট রাখতে হলে প্রয়োজন ঐ অনলস তৎপরতার-ঐ অতন্দ্র সতর্কতার। দেবসেনাপতি কার্ত্তিক ও তাঁর বাহন ময়ূরের কল্পনায় আমাদের পূর্বপুরুষগণ সেকথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন।