
কার্ত্তিকের বর্ণনা
কার্ত্তিকের জন্ম অমাবস্যা তিথিতে। পরবর্তী পাঁচদিনে তাঁর প্রাপ্তবয়স্কতা লাভ। ষষ্ঠদিনে তাঁর দেবসেনাপতিত্বে অভিষেক এবং দেবসেনার আধিপত্য লাভ, যুদ্ধাভিমান ও বিজয়। একমতে তাঁর পত্নীর নাম ‘দেবসেনা’। তিনি ব্রহ্মার কন্যা। শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতেই দেবসেনার সঙ্গে কার্ত্তিকের বিবাহ। দেবসেনার অপর নাম ষষ্ঠী। শুক্লা ষষ্ঠী তিথি বিজয়াদি সকল অভীষ্টদায়িনী। বৌধায়ন গৃহ্যসূত্রে স্কন্দের একটি নামও ‘ষষ্ঠী’। লক্ষণীয়, আশ্বিনের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতেই দেবী দুর্গার বোধন অর্থাৎ দুর্গাপূজার সূচনা। এর তাৎপর্য এই যে, ক্ষাত্রশক্তির সঙ্গে যখন ব্রহ্মতেজ সমন্বিত হয়, তখনি বিজয়াদি সর্বাভীষ্ট মানুষের করতলগত হয়। তখনি মানুষের মধ্যে শিবশক্তি অর্থাৎ শুভশক্তির উদ্বোধন ঘটে। সেই উদ্বুদ্ধ দেবাত্মশক্তির কাছে অসুরের পরাজয় অনিবার্য। কারণ, সমস্ত দেবাত্মশক্তির ওপর যাঁর আধ্যিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত, ত্রিভুবনের সমস্ত প্রতিরোধই তাঁর সম্মুখে চূর্ণবিচূর্ণ হতে বাধ্য। সেই আধ্যাত্মিক অর্থে যিনি দেবসেনাপতি, তাঁর কণ্ঠে বিধাতাকন্যার জয়মাল্য দোলে-তিনিই বিধাতাকন্যাকে লাভ করেন। বিধাতা কন্যার নাম ‘দেবসেনা’। ‘দেবসেনা’র অর্থ দেবশক্তি। অর্থাৎ দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি কার্ত্তিকের অধিন। সেজন্য তিনি দেবসেনাপতিরূপে স্বীকৃত। সম্মিলিত দেবাত্মশক্তিকে যথার্থভাবে ব্যবহার ও পরিচালনা করে সভ্যতাকে সুরক্ষিত রাখার গুরুদায়িত্ব তাঁর স্কন্ধে অর্পিত। দেবী দুর্গার পরিবার সমগ্র বিশ্বচরাচর। তাঁর স্নেহাঞ্চলে পশু, পাখি, সরীসৃপ, উদ্ভিদ, মানুষ-সকলেই আচ্ছাদিত। সেই বিশ্ব-পরিবার রক্ষার দায়িত্বে দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র কার্ত্তিকেয় নিযুক্ত। এই দায়িত্ব তিনি লাভ করেছেন দেবীর পুত্রের অধিকারে নয়, তাঁর আপন যোগ্যতায়। তেজস্বী, ক্ষিপ্রকর্মা, সদা উদ্যমী, অকুতোভয়, অপরাজেয় ও সুদর্শন কার্ত্তিকেয় শুধু স্বর্গ বা দেবলোকের সেনাপতি নন, সমগ্র মানবলোকেরও ঊর্ধ্বায়ত বীর্য ও শক্তির তিনি প্রতীক-বিগ্রহ। বস্তুত, কার্ত্তিকের পরিচয় একজন বিশেষ দেবতারূপে নির্দিষ্ট হলেও তাঁর মধ্যে অন্তত রুদ্র, অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র ও বিষ্ণু-এই প্রধান বৈদিক পঞ্চদেবতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। বৈদিক দেবভাবনা ভিন্ন পৌরাণিক, তান্ত্রিক ও লৌকিক নানা দেবভাবনা এবং দেবতার মানবিকীকরণ-অভীপ্সার সংমিশ্রণে কার্ত্তিকের উপাসনা ও রূপভাবনা সমৃদ্ধ হয়েছে। সম্ভবত এই প্রক্রিয়া পূর্ণ পরিণতি প্রাপ্ত হয় গুপ্ত যুগে-খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে। তবে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, নারায়ণ উপনিষদ্, বৌধায়ন ধর্মসূত্র, মহাভারত, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, পৃথক দেবতা হিসাবে কার্ত্তিক পূজিত হতে শুরু করেছেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর বহু আগে থেকেই।