
দণ্ডকে দেবী রুদ্রাণী
দম্ভ! শক্তির! ধরাকে সরা দেখছিস তো? জানিস না, অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে!
মায়ের কথা ডুবে যায় অসুরের অট্টহাস্যে। গর্বে উদ্ধত অসুর অময় হেসেই যায়। হাসতে হাসতেই বলে, জ্ঞান দিচ্ছ! শক্তিতে পারবে না বলে কথায় মারতে চাইছ! ওতে চিঁড়ে ভিজবে না!
জ্বলে উঠল চোখ। যেমন জ্বলে আগুন। স্নেহ-মমতায় ভরা মায়ের দুটি চোখ তখন আর করুণায় ছলছল নয়, ও চোখে শুধুই আগুন। সে আগুনে পুড়ে ছাই হয় সব। সে আগুনের আঁচ লাগে অসুর অময়-এরও গায়ে। তবু হাসি থামে না তার।
সৌম্যা মা এবার রুদ্রাণী। তুলে নিতে যান অস্ত্র। তারপর সংযত করেন নিজেকে। বলেন, তোকে মারব না নিজের হাতে। আমার হাতে মার খাওয়ার মতো পুণ্য তুই করিসনি। তোকে মারবে আমার ছেলে গজানন আর তার সুহৃদ পরশুরাম। ওরাই হত্যা করবে তোকে।
অময় অসুরের চোখে মুখেও তখন বিদ্রূপ। তীব্র কণ্ঠেই বলে নিজে পারবে না তাই ভয় দেখাচ্ছ গণেশের আর পরশুরামের। বেশ, ডাকো তোমার গণেশ আর পরশুরামকে। দেখি কত শক্তি ধরে তারা।
গণেশ সেদিন খেলছিল। হঠাৎই সেখানে হাজির অময় অসুর। নিজের খেয়ালেই আক্রমণ করে গণেশের সঙ্গীদের। আর তাই দেখেই ক্রুদ্ধ দেবী বলেন, তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে। তুই যখন গণপতির সঙ্গীদের আক্রমণ করেছিস, তখন তার ক্রোধের আগুনে ছাই হবি তুই। গণেশের সুহৃদ পরশুরামের কুঠারে ক্ষতবিক্ষত হবি তুই। গণেশের কোপানলেই জীবন যাবে তোর।
অময়াসুর মুখে বীরত্ব দেখালেও দেবীর এই কথায় খুবই ভয় পেয়ে গেল। অময় তো জানে, মহামায়া এই দেবীর মায়াতেই মুগ্ধ এই জগৎ। তাঁর ইচ্ছামাত্রই এ জগৎ সংসার লয় পেতে পারে। আর তাই কিছুটা ভয় পেয়েই গণেশের সঙ্গীদের ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে একরকম পালিয়েই যায় অময়।
পালিয়েও রেহাই নেই। ভয় যেন ছায়ার মতোই তাড়া করে চলেছে। অময় মনে মনে ভাবে, কেন এমন হচ্ছে! সে তো এর আগে বহুবারই দেবতাদের হেলায় হারিয়েছে। ব্রহ্মা কিংবা ইন্দ্র-কেউই তো তাকে প্রতিহত করতে পারেনি। বরং তারা প্রত্যেকেই ঝড়ের মুখে ঝড়ে পড়া পাতার মতোই উড়ে গেছে। তাহলে?
অময় অনুভব করে, আপন শক্তিতে সে দেবতাদের প্রতিহত করেছে, এটা সত্যি। কিন্তু মহাশক্তি মহামায়া এবার ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আর ঠিক সেই কারণেই মহাপরাক্রমশালী হয়েও সে আজ ভীত। মৃত্যু তার পিছনে খ্যাপা মহিষের মতোই তেড়ে আসছে। এর থেকে রেহাই দিতে পারেন একমাত্র দেবীই। কিন্তু অসুররাজ হয়ে সে দেবীর কাছে মাথা নিচু করতে পারে না। পায়ে পড়ে চাইতে পারে না জীবনভিক্ষা। কেননা তাতে প্রাণ বাঁচলেও, বাঁচবে না সম্মান। আর জীবনে যদি সম্মানই গেল, তাহলে আর বেঁচে থেকে কী লাভ? তারচেয়ে বরং তপস্যার মধ্যে দিয়েই সংগ্রহ করা যাক জীবনের রসদ।
এ রকম একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরে অময় দারুণ খুশি। তাই আর দেরি নয়, রাজ্যভার মন্ত্রীদের ওপর ছেড়ে দিয়ে অময় চলে যায় জটাখ্য পাহাড়ে। সেখানে শুরু করে কঠোর তপস্যা।
অময়ের তপস্যার রূপ দেখে এবার শংকিত হন দেবতারাও। ভাবেন, এই তপস্যায় সফল হলে এই ত্রিসংসারে অময় হবে অপরাজেয়। আর সেটা হতে দেওয়া যায় না কোনোমতেই।
হতে দেওয়া যায় না, এমন ভাবা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কেমন করে যে সেই হওয়াটাকে ঠেকানো যায় তা জানা নেই দেবতাদের। তাই কাঁপতে থাকেন তাঁরাও।
ওদিকে অময়ের সেই কঠিন তপস্যায় প্রীত হন স্বয়ং জনার্দন-নারায়ণ।
এতদিন কঠোর তপস্যার মধ্যে দিয়ে যাঁকে পেতে চাইছিল, আজ তাঁকেই সামনে দেথে প্রণত হয় অময়। তুষ্ট নারায়ণ বলেন, অময়, তোমার কঠিন তপস্যায় খুশি হয়েছি আমি। যার আশায় তোমার এই তপস্যা তা পূর্ণ হবে জেনো। তুমি হবে অপরাজেয়-মহাপরাক্রমশালী। সুরাসুর হবে তোমার পদানত। সবাই ভয় পাবে তোমাকে।
এমন আশাতীত প্রাপ্তির আনন্দে অময় আত্মহারা। বারবার প্রণাম জানাতে থাকে সে নারায়ণকে।
তার আনন্দ দেখে হাসেন নারায়ণ। শান্ত কণ্ঠেই বলেন, কিন্তু অময়, অমর হবে না তুমি। মৃত্যু তোমার হবে রণক্ষেত্রে ব্যূহমধ্যেই। তাই সাবধান! পঁয়ত্রিশতম ব্যূহ পর্যন্ত তুমি অজেয়। কিন্তু ওই ব্যূহ অতিক্রম করলেই মৃত্যু তোমার অনিবার্য।
পঁয়ত্রিশতম ব্যূহ পর্যন্ত অজেয় এই কথাটা শোনার পর আর কিছুই শুনতে চায় না অময়। তার সামনে এরচেয়ে বেশি ব্যূহ রচনা করবে কে? কার আছে সে সাহস? আর যদি কেউ করেও তাহলে বুঝতে হবে সে দুর্বল। দুর্বল প্রতিপক্ষকে অময়ের আবার ভয় কীসের?
বিচিত্র এক আত্মপ্রসাদে স্ফীত অময় বলে, আপনার অশেষ কৃপা, প্রভু। আপনাকে জানাই আমার শত সহস্র প্রণাম।
অহমিকার ঘন অন্ধকার ঘিরে ধরে অময়কে। এর বাইরে দৃষ্টি যায় না তার। ওই ঘন বৃত্তকেই সব পথ মনে করে অময়। এবং এ কারণেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সে পদানত করে অসুরদের। অময় হয় অসুর সম্রাট। স্বর্গ থেকেও সে বিতাড়িত করে দেবতাদের। সে হয় স্বর্গাধিপতি। ত্রিভুবন জুড়ে চলতে থাকে তার অত্যাচার। দেব-ঋষি-ব্রাহ্মণ-সকলেই হয় অময়ের লাঞ্ছনার শিকার।
দেববলে বলীয়ান অময় অগ্রাহ্য করে সকলকেই। সকলকে হতমান করাই হয়ে উঠল তার ধর্ম। মদমত্ত অময় এইভাবেই একদিন এল দণ্ডকবনে। দণ্ডকারণ্যে তখন বাস করছেন পরশুরামের পরমপ্রিয় গজানন। মদমত্ত অসুর দণ্ডকবনে গজাননের প্রাণপ্রিয়া অগস্ত্যকন্যা সুমতিকে দেখে তাঁকে গ্রহণ করার জন্য উদ্যত হয়।
অসুরের ওই ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারেন না পরশুরাম। কুঠার হাতে বেরিয়ে আসেন তিনি। সেনাদের ব্যূহ রচনা করতে করতেই পরশুরাম বলেন, ওহে দানব, একটু অপেক্ষা করো। আমার সেনা সাজিয়ে নিই। তারপর দেখব তুমি কত বড় বীর। আর তার আগেই যদি এখান থেকে পালাবার চেষ্টা কর, তাহলে দেখছ আমার এই কুঠার-এই কুঠার দিয়েই দু’টুকরো করব তোমার বুক। তখনই বুঝবে, মিথ্যা দম্ভের ফল কী হয়!
পরশুরামের কথায় অময় রাগে যেন আগ্নেয়গিরি। তার চোখ-মুখ-দেহ সব কিছু থেকে আগুন ঝরতে থাকে। পরশুরামের কথার উত্তর মুখে না দিয়ে অস্ত্রে দেয়। বাণে বাণে আচ্ছন্ন করে সে পরশুরামকে। বর্ষাকালে আকাশ ভেঙে যেমন বৃষ্টি নামে, ঠিক তেমন ভাবেই একের পর এক তীর ছুঁড়তে থাকে অময়। বাণের ধারাবর্ষণে অন্ধকার হয়ে যায় চারিদিক। পরশুরাম আচ্ছন্ন তখন দানবের শরজালে।
পরশুরামকে বিপদগ্রস্ত দেখে আর স্থির থাকতে পারেন না গজানন। এগিয়ে আসেন বন্ধুর সাহায্যে। অগস্ত্যকন্যা সুমতিকে পিছনে রেখে গজানন রচনা করতে থাকেন একের পর এক ব্যূহ। সুরক্ষিত, সুসজ্জিত শতাধিক ব্যূহ রচনা করেন গজানন।
গজাননকে ওইভাবে ব্যূহ রচনা করতে দেখে অময়ও পাল্টা ব্যূহ তৈরি করে আক্রমণ হানে। এক এক করে প্রতিপক্ষের পঁয়ত্রিশটি ব্যূহ ভেদ করে অময়। জয়ের আনন্দে মদমত্ত অময় ভুলে যায় নানায়ণের সবধানবাণী। অথবা নিজের জয়ের সাফল্যে সেই সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করেই ছত্রিশতম ব্যূহে প্রবেশ করে সে।
অময়কে এগিয়ে আসতে দেখে বন্ধুবলে বলীয়ান পরশুরাম এবার হাতে তুলে নেন ধনুকবাণ। একের পর এক তীর ছুঁড়ে তিনি ছিন্ন করেন অময়ের ধনুক।
রাগে অন্ধ অময় সঙ্গে সঙ্গে নেয় আরেকটি ধনুক। তীরে তীরে এবার আচ্ছন্ন হন পরশুরামই। বন্ধুকে এভাবে আক্রান্ত হতে দেখে স্থির থাকতে পারেন না গজানন। অস্ত্র ধরেন তিনি। ছোঁড়েন বরুণবাণ।
আশ্চর্য ভয়ংকর সেই বরুণাস্ত্র। চারিদিক থেকে শোনা যেতে থাকে মেঘগর্জন। অশনিসম্পাতে আলোকিত হতে থাকে দিঙ্মণ্ডল। বর্ষা নামছে ভেবে ভেককুল ডাকতে থাকে মকমক করে। চাতক-চাতকী উদগ্রীব হয় জলপানে। ময়ূর নাচে পেখম মেলে। তারই মধ্যে সেই বরুণাস্ত্র নিহত করতে থাকে অময়-সেনাদের। কত হাজার হাজার অসুর যে মারা গেল তার কোনও লেখাজোখা নেই।
ওই ভাবে নিজের সেনাদের নিহত হতে দেখে অময় পাল্টা ছোঁড়ে বায়ুবাণ। সেই অস্ত্রে উড়ে যায় বরুণাস্ত্র। হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকে প্রতিপক্ষের রথ, গজ, অশ্ব এবং সেনানি।
অময়কে বায়ুবাণ ছুঁড়তে দেখে পরশুরাম এবার ছোঁড়েন অগ্নিবাণ। সেই বাণের দহনে জ্বলতে থাকে অসুরসেনা। উপায় না দেখে অময় এবার ছোঁড়ে নারায়ণাস্ত্র।
অময়কে নারায়ণাস্ত্র ছুঁড়তে দেখে ভীত হন দেবতারা। পরশুরাম যে এই অস্ত্রকে কোনও ভাবেই প্রতিহত করতে পারবেন না এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত দেবতারা ভয়ে এবং হতাশায় সেই জায়গা ছেড়ে পালাতে থাকেন।
অতি ভীষণ সেই নারায়ণাস্ত্র প্রতিহত করতে পরশুরাম ছোঁড়েন ব্রহ্মাস্ত্র। অতি ভয়ানক সেই দুই অস্ত্রের দীপ্তিতে চারিদিক যেন ঝলসে ওঠে। দুই অস্ত্রের সংঘর্ষে যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই হবে ধ্বংস সে ব্যাপারে নিশ্চিত সবাই। এই দুই অস্ত্রকে কীভাবে প্রতিহত করা যায় তা নিয়ে সকলে যখন চিন্তামগ্ন সেই মুহূর্তে গজানন স্মরণ করেন পাশুপত অস্ত্রকে। সেই অস্ত্রের যথাবিহিত অর্চনা করে এবার সেটি নিক্ষেপ করেন তিনি।
অতি-অতি ভয়ংকর সেই অস্ত্র নারায়ণাস্ত্র আর ব্রহ্মাস্ত্রর মাঝখান দিয়ে গিয়ে আঘাত করে অসুর সেনাদের। বিনষ্ট হয় সমস্ত অসুর সেনা। নিহত হয় অসুর অময়ও। চরাচরে নেমে আসে শান্তি।
মহামায়ার ইঙ্গিতেই গজানন সেদিন প্রয়োগ করেন পাশুপত অস্ত্র। সংহত করেন নারায়ণাস্ত্র এবং ব্রহ্মাস্ত্রকে। দণ্ডাকারণ্যে সেদিন মহাপ্রলয়ের আশঙ্কাকে ভাসিয়ে দিয়ে বইতে থাকে মহাশান্তির প্রবাহ। শান্তির সেই মুহূর্তে দণ্ডকবনে সনাতনী দেবী হলেন রুদ্রাণী। তাঁর পূজায় নিরত হলেন দেবগণ নিখিল বিশ্বের সকলকে নিয়ে। রুদ্রাণীর সেই রুদ্ররূপের আড়ালেও দু’চোখে ছলছলিয়ে ওঠে মাতৃস্নেহ। সেই স্নেহধারায় নিষ্ণাত-দেবতা-মানুষ-বিশ্বচরাচর।