
কাশীর নবদুর্গা - দেবী শৈল পুত্রী
আলাইপুরার মড়ীঘাটের কাছে-দেবী শৈলপুত্রীর মন্দির। নবদুর্গার প্রথম দুর্গা। চারিদিক পুরানো প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বেশ বড় চত্বর। সামনেই সুন্দর একটি নূতন তোরণ। প্রবেশের মুখেই একটি বহু প্রাচীন ইদারা। এটি নাকি সেই প্রাচীন কালের সাক্ষী। চত্বরে প্রবেশ করেই বাঁ দিকে লাল রং করা ছোট মন্দির-বোঝা যায় এটি বেশি পুরানো নয়। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের উপর পরে তৈরি করা। ছোট অন্ধকার গর্ভগৃহ। তারই পশ্চিম দেওয়ালে দেবীর ছোট কষ্টিপাথরের বিগ্রহ, সর্বাঙ্গ লাল কাপড়ে ঢাকা -শুধু মুখখানি বের করা, নাকে ছোট নথ পরা। দেবী বৃষারূঢ়া-দক্ষিণ হাতে ত্রিশূল ও বামহাতে পদ্ম ধরা। সব স্পষ্ট বোঝা যায় না। কালো পাথরের দেওয়ালের মধ্যে খোদাই করা বিগ্রহ। দেবীর সামনেই ছোট কুণ্ডের মধ্যে কাশীখণ্ডস্থিত প্রাচীন শিবলিঙ্গ-শৈলেশ্বর। দেবীর ভৈরব। হাতখানেকের বেশি উঁচু নয় মায়ের মূর্তি ও শিবলিঙ্গটিও। তবে বেশ সুন্দর করে জবা ও কলকে ফুল দিয়ে দেবী ও দেবতাকে সাজানো আছে।
‘বন্দে বাঞ্ছিত লাভায় চন্দ্রার্ধকৃত শেখরাম / বৃষারূঢ়াং শূলধরাং শৈলপুত্রীং যশস্বিনীম্’।
পুরাণে বলা হচ্ছে এই দেবী তাঁর ত্রিশূল তুলে ভক্তদের অভয় দিতে উপসর্গাদিকে তর্জন করেছেন। মন্দিরের বাঁ দিকে একটি লাল রং করা ছোট শিবের মন্দির -তারও অন্য পাশে সম্ভবত পূজারীদের থাকবার ঘর। মন্দিরের কোন নাটমন্দির নেই। সামনে একটু খোলা চত্বরের বিপরীত আরও তিনটি ক্ষুদ্রাকৃতি শিবমন্দির - তার পাশে বিরাচ প্রাচীন বটগাছ বেদী বাঁধানো আরও পূর্বদিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে তেতুল, নিম, অশ্বত্থ, বেলগাছের সারি। তারও উত্তরে বরণা নদী।
সৃষ্টিকর্র্তা ব্রহ্মাকোনো একসময় ব্যাসশিষ্য শতানীকে বলেছিলেন, দেবীর মাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের আগে দেবীকে স্মরণ করতে হয় বিশেষ ভাবে, যাতে এই পাঠ নির্বিঘ্ন হয়। আরও ভাবতে হয়, মা কৃপাময়ী সর্বদা আমাকে সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ থেকে যেন রক্ষা করেন-সর্বব্যাপিনী দেবী জগদম্বা নানান নামে পাঠকের শরীরের সর্বাঙ্গ জুরে -সমগ্র দেহব্যাপিনী হয়ে তাকে যেন রক্ষা করেন। কবচ যেমন সমস্ত অমঙ্গল থেকে রক্ষা করবার জন্য লোকেরা দেহে ধারণ করেন সেইরকম এই বাত্ময়ী দেবীর নামলহরীও কবচের মতো সাধক ভক্তিমান পাঠককে সর্বতোভাবে রক্ষা করবে।
অত্যন্ত রহস্যময়ী সকল জীবের কল্যাণকারী সেই দেব স্তোত্রকবচের একেবারে প্রারম্ভে ব্রহ্মা বলেছেন এই নয়টি দেবীর নাম-“প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী। তৃতীয়ং চন্দ্রঘন্টেতি কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্। পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি,ষষ্ঠং ক্যাত্যায়নী তথা। সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমম্। নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদুর্গাঃ প্রকীর্ত্তিতাঃ।” নানা দৈব দুর্বিপাক বিপত্তারিণী দুঃখহারিণী এই দেবীদের নাম স্মরণমাত্র ঘুচে যায়, সব বিপদ দুঃখ দূর হয়।
দক্ষযজ্ঞে দেবী ভগবতী সতী যখন শিবনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করলেন, তখন মহাদেব ক্রোধে উন্মত্ত ও শোকে বিহ্বল হয়ে সেই দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে উন্মত্তের মতো সারা ত্রিলোক ঘুরতে লাগলেন। ত্রিভুবন তাঁর তাণ্ডবনৃত্যে সন্ত্রস্ত কম্পিত হয়ে উঠল। বিশ্বের এই বিপদ সামলাবার জন্য নারায়ণ তাঁর সুদর্শন চক্রে শিবস্কন্ধস্থিত দেবীর শরীর একটু একটু কবে কেটে ফেলতে লাগলেন। দেবী দেহের সেই টুকরো যেখানে পড়ল সেখানে সৃষ্টি হল একান্নটি শক্তিপীঠ। আর এদিকে ভাববিভোর শংকর তাঁর কাঁধে দেবীর শরীর না পেয়ে আত্মস্থ হয়ে কৈলাসে গিয়ে ধ্যানে বসলেন। শক্তি লাভের জন্য শুরু হল মহাদেবের তপস্যা।
অন্যদিকে স্বর্গরাজ্যে তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা বিপন্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি বিধান দিলেন -উপযুক্ত সেনাপতির অভাবে তোমাদের এই পরাজয়। এই সেনাপতি হবেন,শিব-শক্তির মিলনের ফলে সৃষ্ট হবেন যিনি,সেই কুমার। দেবতারা তখন দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়াকে কাতর হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন - ‘মা, তুমি এসো, আবির্ভূত হও, শিবসঙ্গে আবার বিরাজিত হও-আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য তোমার ও দেবাদিদেবের মিলনে একটি উপযুক্ত সেনাপতি আমাদের দান কর।’ দেবতাদের এই কাতর প্রার্থনায় মহাদেবী দুর্গা আবার মর্ত্যশরীর ধারনে স্বীকৃতা হলে। এর আগে নাগাধিরাজ হিমালয় ও পত্নী মেনকা স্বয়ং জগদম্বাকে কন্যারূপে পাওয়ার জন্য অনেক তপস্যা করেছিলেন। এখন দেবতাদের ইচ্ছা ও হিমালয়ের প্রার্থনা পূর্ণ করবার জন্য দেবী পার্বতী হৈমবতী কন্যা হয়ে হিমালয়ের গৃহে জন্ম নিলেন। তখনই তাঁর নাম হল শৈলপুত্রী। এই দেবীর সৃষ্টি এইভাবেই হয়েছিল। ইনিই পরে শিবের জন্য তপস্যা তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্ত্তিকের জন্মদান করেন।