Increase Reset Decrease

দুর্গা তত্ত্ব

চণ্ডীতে আছে-তাঁর শাকম্ভরী অবতারে “তত্রের চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরং। দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।” দুর্গম নামে এক অসুরকে বধ করার জন্য তাঁর নাম হবে দুর্গাদেবী। এছাড়াও দর্গা শব্দটির নানা অর্থ হয়। যেমন- “দুর্গেতি দৈত্যবচনো অপি ‘আ’কারো নাশবাচকঃ। দুর্গং নাশ্যতি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতাঃ। বিপত্তি বাচোক দুর্গাশ্চাকারো নাশ বাচকঃ।তং ননাশ পুরা তেন বুধৈ দুর্গা প্রকীর্তিতাঃ।।” দেবী ভগবতে এই সুন্দর কাহিনীটি আছে। আবার ‘দুর্গ’ শব্দটি দৈত্য ও বিপদবাচক আর ‘আ’ শব্দটি সেটি বিনাশ করে-এই দুটি শব্দ মিলে পণ্ডিতের মতে দুর্গা শরব্দর উত্পত্তি। চণ্ডীতে আছে ‘দুর্গাসি দুর্গভবসাগর নৌরসঙ্গা’-অর্থাৎ অসঙ্গা অনাসক্ত সর্ববিষয়ে, নির্লিপ্তা সকল জাগতিক বিষয়ে, তাই তুমি দুর্গম ভবসমুদ্রে, যেখানে প্রতিপদে ভোগাসক্তি জীবকে ডুবিয়ে মারে সেই রকম ভব পারাবারে একমাত্র পারের তরণী। তোমাতে যে আশ্রয় নেয়, ভববারিধি সে হেলায় পার হয়ে যায়। তাই তুমি দুর্গা। আরও আছে , যেমন “দুর্গোদৈত্যে মহাবিঘ্নেভববন্ধে কুকর্মণি। শোকে দুঃখে চ নরকে/যমদণ্ডে চ জন্মনি। মহাভয়ে অতিরোগে চাপ্যাশব্দো হস্তুবাচকঃ।এতান্ হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্তিতাঃ।।” এর মানে হচ্ছে ‘দুর্গ’ শব্দ শব্দ-কল্পদ্রুমের মতে-দুর্গ নামের অসুর, মহাবিপদ, জন্মমৃত্যু-সংসারবন্ধন, অসত্কর্ম, শোকে, দুঃখ, নরক ভোগ, যমযন্ত্রণা, বারবার দেহধারণের কষ্ট, মহাভয় ও নিদারুণ শারীরিক কষ্টদায়ক ব্যাধি। এই এগারোটি কষ্ট। আর ‘আ’ শব্দ বিনাশসূচক। এখন দুই শব্দের মিলিত অর্থ-যিনি এই একাদশ বিপদ থেকে রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। আবার-দৈত্য নাশার্থবচনে ‘দ’কার প্ররিকীর্তিতাঃ,‘উ’ কার বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মতঃ। রোফো রোগঘ্ন বচনো, ‘গ’শ্চ পাপঘ্নবাচকো। ভয় শত্রুঘ্নবচনশ্চাকার প্ররিকীর্তিতাঃ।। দৈত্যনাশক ‘দ’,বিঘ্ননাশক ‘উ’, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ পাপনাশক, শত্রুনাশের ভয় নাশক ‘আ’ কার। তাছাড়া “স্মৃতি উক্তি শ্রবণাদ্ যস্যা এতে নশ্যন্তি নিশ্চিতম্। এতো দুর্গা হরেঃ শক্তিঃ হরিণা প্ররিকীর্তিতা।” যাঁর নাম স্মরণ, উচ্চারণ ও শ্রবণ করলে নিখিল বিঘ্ন, সকল প্রকার ব্যাধি, সর্বপাপ, সমস্ত ভীতি ও সমস্ত শত্রুনিশ্চিতভাবে বিনষ্ট হয়। স্বয়ং হরি বলেছেন -সেই বৈষ্ণবী শক্তি ‘দুর্গা’ নামে আখ্যাত হবেন।

যিনি সর্বমন্ত্রের মাতৃকাস্বরূপিণী, যিনি সকল জ্ঞানের উত্সস্বরূপা, যাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই সেই আমার, অজ্ঞেয়া, অনন্তা, অলক্ষ্যা, জন্মরহিতা, নিত্যা, অদ্বিতীয়া আবার বহুরূপিণী, চিন্ময়ী, ‘শূন্যানাং শূন্যে সাক্ষিণী সৈষা দুর্গা প্রকীর্তিতা’-তিনি দুর্গা নামে বিখ্যাতা। সংসারের স্বার্থান্ধতা আর আধ্যাত্মিক জগতের অবিদ্যা। জীবের এই দুর্গতি দূর করে, লোককল্যাণকর নিঃস্বার্থ বুদ্ধি দান করে ও তার অজ্ঞান-অবিদ্যা নাশ করে তাকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত যিনি করেন, তিনিই দুর্গা। তাই সেই আদি কাল থেকে এখন পর্যন্ত দেবী দুর্গা দেবতাদের যেমন দৈত্যদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, তেমনি তাঁর মর্ত্যলোকবাসী আর্ত ব্যাকুল সন্তানদের রক্ষার জন্য সদাজাগ্রত অতন্দ্র প্রহরীর মতো তাকে দুর্গের মধ্যে রেখে সর্বতোভাবে রক্ষা করেছেন। তবে ‘যে তাকে চায় সে তাকে পায়, যে তাঁকে চায় না তাকে পঞ্চভূতে নাচায়।’

Print