Increase Reset Decrease

দুর্গা-মহিষাসুর যুদ্ধের সামাজিক তাৎপর্য্য

মহিষাসুর ও মহিষাসুরমর্দিনীর সংগ্রাম এবং পরিশেষে মহিষাসুরমর্দিনী কর্তৃক মহিষাসুরের পরাভব প্রকৃতপক্ষে মানুষের অন্তরস্থিত দেবতা ও দানবের-শুভশক্তি ও অশুভশক্তির সংগ্রাম এবং পরিশেষে শুভশক্তির নিকট অশুভশক্তির পরাজয়ের প্রতীক। সুতরাং কবে, কোথায় কেন, কিভাবে তাঁর আবির্ভাব ও সংগাম-সেসব প্রশ্ন অবান্তর। পুরাণের সংগ্রাম-কাহিনীর বাস্তবতা নিয়ে বিচার গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই চলতে পারে, কিন্তু আমাদের অন্তর্জগতে যে নিরন্তর শুভ ও অশুভের সংগ্রাম চলছে এবং সেই সংগ্রামে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি তার বাস্তবতা আমরা কেমন করে অস্বীকার করব? এই সংগ্রাম যেমন অনাদি, তেমনি আপেক্ষিক বিচারে তা অনন্তও। এবং এই সংগ্রাম পুরাণ-কথিত সংগ্রামের চেয়েও কঠিনতর। যতদিন সৃষ্টি থাকবে ততদিন মানুষের মধ্যে এই সংগ্রাম চলতে থাকবে। দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ যেমন মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের চিরন্তন যুদ্ধের প্রতীক, তেমনি কুরুক্ষেত্রে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধও তার প্রতীক। আমাদের সবার মনই তো নিত্য কুরুক্ষেত্র। সেই কুরুক্ষেত্রে যখন আমাদের শুভ বৃত্তির কাছে অশুভ বৃত্তি পরাভূত হয় তখন তা হয়ে ওঠে ‘ধর্মক্ষেত্র’ এবং সেই যুদ্ধ হয়ে ওঠে ‘সাধন-সমর’। সেই ধর্মক্ষেত্রের শক্তিতেই, সেই সাধন-সমরের সম্পদেই সভ্যতা সুরক্ষিত থাকে। সেই শক্তিতেই দেশ, সমাজ, পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। যুগে যুগে ‘চণ্ডী’ ও ‘গীতা’, দুর্গা, কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে আমরা নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাই। এই পৃথিবীর অন্ধকার, ত্রাস, সংশয়, যন্ত্রণা, প্রতারণার মধ্যেই প্রতিশ্র“তি পাই আলোয় ভরা এক নতুন ভুবনের।

পুরাণ-প্রমাণ অণুসারে মহিষাসুরের জন্মের পিছনে তাঁর অসুর জনক-জননীর অন্তরে ক্রিয়াশীল ছিল ভোগলিপ্সা, ইন্দ্রিয়পরতা এবং ক্ষমতালোলুপতা। পক্ষান্তরে দেবতেজোসম্ভূতা মহিষমর্দিনীর জন্মের পটভূমিতে ছিল সকল দেবতার জগৎকল্যাণেচ্ছা। সেই হেতু আমাদের পুরাণকারগণ আমাদের অন্তরস্থিত অশুভশক্তিকে পশুরূপে অর্থাৎ ঘোর ইন্দ্রিয়াসক্ত, ভোগসর্বস্ব, ক্ষমতালোলুপ মহিষাসুররূপে এবং শুভশক্তিকে সকল দেবগণের অঙ্গ-নিঃসৃত তেজঃপুঞ্জের সাকার প্রকাশরূপে অর্থাৎ নিখিল দেবসত্তার সমষ্টিভূত বিগ্রহ দুর্গারূপে কল্পনা করেছেন। উভয় শক্তিই মানুষের মধ্যে নিহিত রয়েছে।যখন অশুভশক্তি কর্তৃক শুভশক্তি নির্জিত হয় (যেমন মহিষাসুর কর্তৃক স্বর্গস্থ দেবগণ হয়েছিলেন) তখন ব্যক্তিসমাজ, পরিবারজীবনে, সমাজজীবনে এবং রাষ্ট্রজীবনে ঘোর অধঃপতন নেমে আসে; যখন এর বিপরীতটি ঘটে অর্থাৎ শুভশক্তি কর্তৃক অশুভশক্তির পরাভব হয় তখন সর্বত্র কল্যাণ ও মঙ্গল প্রবাহিত হয়।

মানুষের অন্তর্নিহিত এই সংগ্রাম অবশ্যই ক্ষান্তিহীন; কিন্তু সংগ্রাম না থাকলে যে জীবনও অর্থহীন হয়ে যায়। সংগ্রামের মাধ্যমেই মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকশিত হয়। সুতরাং সংগ্রামের একটি শুভঙ্কর দিকও আছে। দেবী চণ্ডীতে (১১।৫৪-৫৫) নিজমুখে অঙ্গীকার করেছেন:
“ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্।।”
-এইভাবে যখনি দানবগণের প্রাদুর্ভাববশত বিঘ্ন উপস্থিত হবে তখনি আমি আবির্ভূতা হয়ে দেবশত্রু বিনাশ করব।

এই ‘দানবগণ’ কারা? তারা আমার লোভ, আমার ভীরুতা, আমার স্বার্থপরতা, আমার সঙ্কীর্ণতা। তারাই দানব। তারাই আমার এবং আমাদের চিরন্তন শত্রু। শত্রু সমাজের, শত্রু সভ্যতার। তাদের জয় করবে কে? আমি এবং আমার। আমাদের অন্তরের দেবশক্তি। কুরুক্ষেত্র আসলে মানবের হৃদয়রূপ চিরন্তন রণক্ষেত্র এবং কৃষ্ণ-নিখিল বিশ্বের সমষ্টিভূত শুভশক্তির প্রতীক। চণ্ডী ও গীতায় যে ঐশী অঙ্গীকার উচ্চারিত বস্তুতপক্ষে একই মুদ্রার উভয় পৃষ্ঠভূমিমাত্র। উভয়েই এক অদ্বয় সত্যের নিত্য উচ্চারণ। অর্থাৎ পুরাণে-কাহিনীর অন্তরালে অপিহিত অর্থাৎ নিহিত এক পরম গভীর সত্যের মুখ।

Print