
কাশীর নবদুর্গা - দেবী কুষ্মাণ্ডা
কাশীপুরীর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিতা দেবী কুষ্মাণ্ডা। কাশীখণ্ডে আছে, অসি সঙ্গমের কাছে দেবী কুষ্মাণ্ডার অধিষ্ঠান, “স্বপ্নেশ্বর্য্যাশ্চ বারুণ্যাং দুর্গা দেবী ব্যবস্থিথা। ক্ষেত্রস্য দক্ষিণং ভাগং সা সদৈবাভিরক্ষতি।” কাছেই স্বপ্নের শিব আছেন, তাঁর কাছে স্বপ্নেশ্বরী দেবীও আছেন। তাঁদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত থেকে দেবী দুর্গা সর্বদা কাশীক্ষেত্রের দক্ষিণ দিক রক্ষা করছেন।
কাশীতে একমাত্র এই দুর্গামন্দিরেই বলিদান নিয়মিত হয়। কালরাত্রি মন্দিরে বছরে একবার। চত্বর পার হয়ে মূলমন্দিরের দরজায় প্রবেশের মুখে দেওয়ালে শ্বেতপাথরে খোদাই করে ইংরাজীতে লেখা আছে, যারা হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী নয় তাদের এই মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। দেওয়ালের গায়ে খুব সুন্দর দুই ব্যাঘ্রবাহনাঅষ্টভুজা মা দুর্গার ছবি আঁকা আছে। লাল পাথরের সুদৃশ্য বহুচুড়ামণ্ডিত উঁচু মন্দিরে দ্বিতীয় দ্বার দিয়ে ভেতরে ঢোকবার পথে সিংহমূর্তি একটি দাঁড়িয়ে আছেন মায়ের দিকে মুখ করে, মাথার উপর সার দিয়ে ঘণ্টা সাজানো। ভক্তেরা যাওয়ার পথে সেই ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দরজার দুদিকে বাঁধানো বারান্দা, তার পরেই নাটমন্দির। আটটি লাল পাথরের সুন্দর নক্শা খোদাই করা থামের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তিনদিক খোলা ছোট নাটমন্দির। সামনেই ছোট গর্ভগৃহে দেবী কুষ্মাণ্ডা বা দুর্গার পশ্চিমমুখী বিগ্রহ। সিংহাসনে আসীনা, সর্বাঙ্গ মূল্যবান পট্টবস্ত্রে আবৃত, শুধু মুখের উপর একখানি ত্রিনয়নী মুখোশ। মাথায় মুকুট। হাত দুয়েক উঁচু মূর্তি। এমনিতে মায়ের শরীর কেমন বোঝা যায় না। দেবী কালো পাথরের ব্যাঘ্রাসীনা অষ্টভুজা দুর্গামূর্তি। দক্ষিণ দিকের চারটি হাতে যথাক্রমে পদ্ম-বাণ-ধনু ও কমণ্ডলু আর বাম উপর থেকে নিচে চক্র, গদা, অমৃতপূর্ণ কলস ও জপমালা। তন্ত্রে দেবী প্রসঙ্গে একটি শ্লোকও আছে- “সুরাসর্ম্প্ণ কলসং রুধিরাপ্লুতমেব চ। দধানাহস্তপদ্মাভ্যাং কুষ্মাণ্ডা শুভদা¯ত্ত মে।।” যদিও তার সঙ্গে এই দেবীর শরীরের সবটা মেলে না। তবে দেবীর নামের অর্থটি খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করলেন। ‘উষ্মা’ শব্দের মানে তাপ। ‘কু’ মানে কুৎসিত-কষ্টদায়ক তাপ হচ্ছে ‘ত্রিতাপ’। আধিভৌতিক - আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিতাপই জীবের দুঃখের কারণ। সর্বপ্রকার বন্ধনের কারণ ত্রিতাপ। জীব সদা জর্জরিত এই ত্রিতাপে। এর হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভই জীবের চরমকাম্য। এই ত্রিতাপ ‘কুষ্মা’ যিনি উদরে ধারণ করেন গ্রাস করেন, তিনিই কুষ্মাণ্ডা। সন্তানকে রক্ষা করতে জননী তার সমস্ত দুঃখ নিজে হরণ করেন। যেমন মহাদেব সমুদ্র মন্থনের সময় সমস্ত হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন, তেমনি জগজ্জননী দুর্গা আদ্যাশক্তি জগতের সর্বপ্রকার জ্বালা-যন্ত্রণার হাত থেকে সন্তানদের সর্বদা রক্ষা করতে করুণায় দ্রবীভূত হয়ে স্বেচ্ছায় সব তাপ নিজের শরীরে গ্রহণ করেন। দূরিতবারিণী-‘ত্রিতাপহারিণী’ মায়ের নাম তাই কুষ্মাণ্ডা।
কিন্তু এখানে দেবী দুর্গা বলেই তাঁর বিশেষ খ্যাতি। কুষ্মাণ্ডা বলে তাঁর পরিচিত শুধুমাত্র বছরের দু দিন। শরৎ ও বসন্তের শুক্লা চতুর্থীর দিন। এই দেবী দুর্গা কাশীর দক্ষিণ দিকের রক্ষয়িত্রী।