দেবীর আশা-যাওয়ার নেপথ্যে

ঘটনা ও দৃষ্টান্ত

ঘুমন্ত মানুষেরা জানতেও পারল না যে, তারা চিরকালের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ধ্বংসের দাপাদাপি আর মানুষের আর্তনাদ, মাটির তলায় মানুষসহ হলে যাচ্ছে বাড়িগুলো, আবার কিছু বাড়ি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে মাটিতে। বিরাট বিরাট ফাটল ও গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আগুন, জল ও অন্যান্য পদার্থ। অসহায় মানুষ কিছু বোঝবার বা জানবার আগেই বসুন্ধরা কেঁপে ওঠে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে। অগণিত মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে ধ্বংস করে দেয় বিহারের একটা অংশকে। বছরটা ছিল ১৯৩৪। সেই বছরের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা মানুষ আজও ভোলেনি। সেবার দেবীর আগমনের দিন ছিল, সোমবার। দিন অনুযায়ী দুর্গার গজে আগমন অর্থাৎ শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। গমন বৃহস্পতিবার। দিন অনুযায়ী দুর্গার দোলায় গমন অর্থাৎ “মরকং ভবেৎ”।

চারদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বযুদ্ধের মহড়া শুরু করেছে, বৃটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এ। এই বছরে দেবী দুর্গার আগমনের দিন ছিল বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ দিন অনুযায়ী দেবীর আগমন “দোলায়” অর্থাৎ “মরকং ভবেৎ”। গমন-রবিবার। দিন অনুযায়ী মায়ের গজে গমন অর্থাৎ “শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা”।

বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তীব্রভাবে। মরকের ঢেউ আছড়ে পড়ছে চারদিকে। দেবীর আগমন গজে। অর্থাৎ শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা কিন্তু গমন বৃহস্পতিবার। এই দিনে গমন হলে দুর্গাকে যেতে হবে দোলায় অর্থাৎ মরকং ভবেৎ। বছরটা ছিল ১৯৪০।

১৯৪১-এ দেবী দুর্গার আগমন ও গমন ছিল শনিবার এবং মঙ্গলবারে। এই বছরেও দিন অনুযায়ী ঘোটকে আগমন ও গমন অর্থাৎ “ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে”। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই বছরে দুর্গার যাওয়া এবং আসা দুটোতেই অশুভের ইঙ্গিত।

ছেলেটা দু’দিন কিছু খায়নি। মা, একমুঠো ভাত দাও কিংবা একটু ফ্যান দাও, আমরা কদিন কিছুই খাইনি মা। কলকাতার পথে পথে মৃত্যুর মিছিল। কঙ্কালসার মানুষগুলোর কোটরাগত চোখ, মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে শুধু জল। মৃত্যুর অপেক্ষায় রাজপথের ফুটপাতে ও অলিতে গলিতে শুধু মৃত্যুর উৎসব। বছরটা ১৯৪৩। এমন ভয়াবহ মন্বন্তর শুধু মর্মান্তিকই নয়, বেদনাময়ও হয়ে আছে মানুষের মনের গভীরে। এই বছরে দেবীর আগমন নৌকায়। দিন অনুযায়ী ফল-পৃথ্বী জলপ্লুতা। দিনটা ছিল বুধবার। দুর্গার গমন-শনিবারে। এই দিনে গমন মানেই দোলায়। অর্থাৎ “মরকং ভবেৎ”। দুর্গার আসা ও যাওয়ার মধ্যে অশুভের ইঙ্গিত।

গ্রামবাংলার বুকে বন্যার তাণ্ডবে মানুষ সর্বহারা হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, প্রচণ্ডভাবে লড়াই করেও অসংখ্য মানুষ যে বছরে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুকে বরণ করেছিল এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অতীতের ইতিহাসকে মুছে দিয়ে চিহ্নিত হয়েছিল স্মরণীয় ইতিহাসে, সেই বছরে দেবীর আগমন ও গমন ছিল-১৯৫৬-তে বৃহস্পতিবারে দেবীর আগমন। অর্থাৎ দিন মিলিয়ে দুর্গার আগমন দোলায়। ফল-“মরকং ভবেৎ”। গমন রবিবার এক্ষেত্রেও দিন অনুযায়ী দুর্গার গজে গমন। ফল-শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। ১৯৫৯-এ দুর্গার আগমন ছিল বৃহস্পতিবারে। তাই দিনকে প্রাধান্য দিয়ে দেবীর আগমন হয়েছিল দোলায়-অর্থাৎ “মরকং ভবেৎ”। অবশ্য মায়ের গমন হয়েছিল গজে। ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। ১৯৮৬-র বন্যাও মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছিল এবং এই বছরে দেবীর আগমন হয়েছিল শুক্রবারে। এ ক্ষেত্রেও দিন অনুযায়ী মা এসেছিলেন দোলায়। ফল-“মরকং ভবেৎ”। অবশ্য তাঁর গমন হয়েছিল গজে অর্থাৎ ফল-শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা।

পণ্ডিত ও জ্যোতিষীদের বক্তব্য মতো সার্বিকভাবে লক্ষ্য করলে জানা যায় যে, তিথি নক্ষত্র ও যোগের একটু তফাৎ হলেও ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস এবং মৃত্যুর জন্য দেবীর যানবাহন বা আসার দিনগুলোতে এতটুকুও নড়চড় হয়নি। সৃষ্টি ও লয়কে কেন্দ্র করে দেব-দেবীদের যোগ-বিয়োগের অঙ্ক চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, আর সেইমতোই বিধিবাক্য বা শাস্ত্রমতও নির্ভুলভাবে অনুসরণ করে পণ্ডিত ও জ্যোতিষীরাও গণনা করে চলেছেন।

Print