স্কন্দমাতা

শ্রী শ্রী “চণ্ডী"তে যে ‘দেবীকবচ’ সংযোজিত-তার ঋষি ব্রহ্মা, ছন্দ অনুষ্টুপ ও দেবতা চামুণ্ডা। শ্রীচণ্ডিকা দেবীর প্রীতি সাধনের জন্য চণ্ডীপাঠের অঙ্গরূপে দেবীকবচ পাঠের প্রয়োগ করা হয়। ঋষি মার্কণ্ডেয় প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই জগতে যা সকল লোকের পক্ষে মঙ্গলকর, অথচ পরম গোপনীয় এবং অন্য কারো কাছে ব্যাখ্যাত হয়নি, সেটা কি? উত্তরে ব্রহ্মা বলে, দেবীর পুণ্য কবচই (বর্ম) অতি গোপনীয় এবং সকল জীবের পক্ষে কল্যাণকর।

Skandamataতারপরই ব্রহ্মা মহামুনি মার্কণ্ডেয়কে নবদুর্গার কথা বলেন। এই নবদুর্গা হলেন,

“প্রথমং শৈল্যপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘন্টেতি কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম।।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টকম।।
নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদুর্গাঃ প্রকীর্তিতাঃ।”

এরপরই ব্রহ্মা বললেন, “এই সকল নাম (নবদুর্গা) সর্বজ্ঞ বেদ কর্তৃক উক্ত হয়েছে।” এই নবদুর্গার পঞ্চম দুর্গা-রূপ হচ্ছে স্কন্দমাতা।

এই সনত্কুমার বা স্কন্দ হচ্ছেন কার্ত্তিক। প্রবল প্রতাপান্বিত তারকাসুরকে বধ করার জন্য দেবতারা একজন উপযুক্ত সেনাপতির সন্ধান করছিলেন। “কালিকাপুরাণ” অনুসারে সেনাপতি-প্রত্যাশী দেবতাদের প্রার্থনায় হর-পার্বতী পুত্রার্থে মিলিত হন। শিব-পার্বতীর এই মিলন এতই দীর্ঘস্থায়ী হয় যে, দেবতারা আর ধৈর্য্য ধারণ করতে পারলেন না। ফলে দু’জনের মিলনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হলো। মহাদেবের সেই স্কন্ন বা স্খলিত বীর্য থেকেই জন্ম নিল এক মহাবীর্যবান কুমার। ছয়জন কৃত্তিকা এই কুমারকে স্তন্যদান ও পালন করেন বলেই এর নাম হয় কার্ত্তিকেয় বা কার্ত্তিক। আর মহাদেবের স্কন্ন বা স্খলিত বীর্য থেকে এর জন্ম বলে নাম হয় স্কন্দ। পার্বতীর পুত্ররূপেই স্কন্দের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই কার্ত্তিকের বিভিন্ন নাম। যেমন-স্কন্দ, সনত্কুমার, ষড়ানন, বিশাখ, গুহ, জয়ন্ত ইত্যাদি। মহাভারতের শান্তিপর্বে স্কন্দকেই সনত্কুমার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অবশ্য এই মহাভারতেই আমরা আরেকজন সনত্কুমারের দেখা পাই, যিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার জ্যেষ্ঠ পুত্র-মহাজ্ঞানী পরমর্ষি। “স্কন্দপুরাণে” আমরা কার্ত্তিকের ১০৮টি নাম দেখতে পাই। “ছান্দোগ্য উপনিষদে” সনত্কুমারকেই স্কন্দ বলা হয়েছে। “মেঘদূতে”র বর্ণনা অনুসারে দেবগিরি হচ্ছে স্কন্দপূজার কেন্দ্রস্থল।

কাশীতে এই নবদুর্গার নয়টি মন্দির আছে এবং নবরাত্রিকালে প্রতিপদ থেকে মহানবমী পর্যন্ত নয়দিন ব্যাপী চণ্ডীতে বর্ণিত নবদুর্গার শ্লোক অনুসারে পর পর দেবীর পূজা হয়। পঞ্চমীর দিন পঞ্চম স্থানে উচ্চারিত স্কন্দমাতার পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে। অবশ্য প্রতিদিনই এই নয়টি মন্দিরে বিপুল ভক্ত সমাগম হয়ে থাকে। যোগীগণের কায়াব্যূহের মতোই এক এক দুর্গার নব রূপভেদ বিভিন্ন ধ্যানের নিমিত্ত শাস্ত্রে এরূপ পরিদৃষ্ট হয়।
প্রজাপতি ব্রহ্মা এই নবদুর্গার নাম করলেন-কারণ, প্রসিদ্ধ নামের জ্ঞাত বিজ্ঞাত হলে নামবাচ্য দেবীর জ্ঞানলাভ হয়। এটাই এই নামকরণের ভাবার্থ।

পিত্রালয়ে সতী পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করার পর ক্রুদ্ধ মহাদেব আপন জটাজাল ছিন্ন করে জন্মদান করেন বীরভদ্রের। এই বীরভদ্র যখন দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন নবদুর্গা। তবে সেই নবদুর্গার নাম আলাদা। আবার কৃষিভিত্তিক আমাদের সমাজব্যবস্থায় আমরা মা দুর্গার সঙ্গে যে নবপত্রিকার )কলাবৌ পুজা করি-তিনিও প্রকৃতপক্ষে নবদুর্গারই স্বতন্ত্র রূপ। সেখানে এক একটি শস্য এক একজন দেবীর প্রতীক।

Print