
কাশীর নবদুর্গা - দেবী মহাগৌরী
মহাগৌরী হচ্ছেন কাশীর অন্নপূর্ণা দেবী, যাঁর কাশীখণ্ডের নাম ভবানী।
মহাগৌরীর মন্দিরে প্রবেশকরে সামনেই বারোটি নানা অলংকার খোদাই করা সুন্দর লাল পাথরের স্তম্ভের উপর নাটমন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে। নাটমন্দির তিনদিক খোলা। সাদা-কালো মার্বেল পাথরের মেঝে। এখান থেকেই ভক্তদের সামনের ছোট্ট গর্ভমন্দিরে অধিষ্ঠিতা মা অন্ন্পূর্ণাকে দর্শন করতে হয়। সিলিং থেকে ঝুলছে ছোট ঘণ্টা। গর্ভমন্দিরের তিনটি ছোট ছোট দরজা।
মা বেদীর ওপর বিরাজ করেছেন, পশ্চিমাস্যা, ফুট দুয়েক মতো উঁচু, সর্বাঙ্গ বস্ত্রবৃতা। মুখখানি শুধু একটি সোনার মুকুটসহ মুখোশ দিয়ে আবৃত। মুকুটের পিছনে আসল মূর্তির মাথায় চূড়াটি দেখা যায়। তার ওপর হলুদ-চন্দন-আলোচাল দূর্বাদিয়ে একটি অর্ঘ্য সকালেই স্নান পূজোর পরে দিয়ে রাখা হয়। দেবীর আসলমূর্তি কালো কষ্টিপাথরের। কোন কোন দিন খুব ভোরে চারটে সাড়ে চারটেয় এলে সেই মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। পূজারীরা দরজা বন্ধ করে স্নান-পূজা-বস্ত্রপরিবর্তন করিয়ে দরজা যখন খোলেন সেসময় মায়ের খোলামুখখানি দেখতে পাওয়া যায়। একখানি আড়াই হাত মতো পাথরের স্ল্যাবে দেবীর মূর্তি রিলিফের মতো খোদাই করা আছে। দেবী দাঁড়িয়ে আছেন। দুই হাতের একটিতে হাতা, অন্য হাতে ছোট হাঁড়ি। সবই পাথরের। মায়ের মাথায় চূড়ার মতো করে চুল বাঁধা। মুখখানি অপূর্ব। চোখে অন্য সব প্রতিমার মতো সাদা শঙ্খ বা কোন ধাতু নেই। একেবারে খোলা চোখ। এতো প্রশান্তি করুণামাখা মুখ মায়ের, দেখে আশ মেটে না। এই চূড়ার ওপরই হলুদ চন্দন এই সব দিয়ে রোজ একটি অর্ঘ্য সাজিয়ে রাখা হয়। সেটি বিশ্রাম পর্যন্ত থাকে। একটু পরেই মুখে কোনোদিন সোনা কোনোদিন রুপোর মুখোশ লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে নানাফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। দেবীর আসনের নিচে একটি অষ্টধাতুর দেবী যন্ত্র আছে। বিশেষ দিনে সেটি বাইরে আনা হয় কুঙ্কুম অভিষেক করার জন্য। দেবীর গর্ভমন্দিরে তাঁর সামনে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ধাতুময়ী দীপধারিণী মূর্তি আছে। যাঁরা জানেন না, তাঁরা মনে করেন এটি বুঝি বাবা বিশ্বনাথের মূর্তি। কিন্তু এখানে সবসময়ের জন্য ভিখারী শিবের কোনো মূর্তি থাকে না। বিশেষ বিশেষ পর্বে দেবীর যখন বিশেষ বিগ্রহ নামিয়ে সাজানো হয় তখনই রুপোর শিবও সাজিয়ে দেওয়া হয়। তখন নিত্যপূজিতা প্রস্তরময়ী এই দেবীর বিগ্রহের সামনেই রুপোর আলাদা সিংহাসন দিয়ে রৌপ্যময়ী সিংহাসনে আসীনা দেবী অন্নপূর্ণার হাঁড়ি হাতা হাতে সুন্দর ছোট বিগ্রহ বসিয়ে দেওয়া হয় নিত্যপূজিতা দেবীকে আড়াল করে। বছরে দু’তিন দিন এই বিগ্রহ নামানো হয়। নবান্ন, রংভরি একাদশী, অন্নপূর্ণা পূজা, শিবরাত্রি-এই সব পর্বে।
আর ধনতেরস অর্থাৎ কার্তিক কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন থেকে দীপান্বিতা অমাবস্যার পরে প্রতিপদ পর্যন্ত মন্দিরের পেছনে দোতলায় সোনার অন্নপূর্ণা দর্শন হয়। ঐ প্রতিপদেই দেবীর অন্নকূট উত্সব। সে এক বিরাট পর্ব। নিরেট সোনার তিনটি বিগ্রহ-দেবী অন্নপূর্ণা আসন করে সিংহাসনে বসা, নানা রত্নালংকারে সর্বাঙ্গভূষিতা, বাঁ হাতে হাঁড়ি, আর ডান হাতে হাতা নিয়ে মাঝখানে; দুই পাশে একটু ছোট সোনার মূর্তি ঐ একই রকমভাবে বসা, নানা গয়নাতে সর্বাঙ্গ সাজানো-এঁরা শ্রীদেবী ও ভূদেবী। তন্ত্রমতে একজন সরস্বতী, অন্যজন মহালক্ষ্মী। আর দেবী মধ্যস্থিতা ভবানী মহাগৌরী অন্নপূর্ণা। তাঁদের ডান দিকে কোণে দাঁড়িয়ে আছেন রুপোর শিব, নৃত্যের ভঙ্গিতে, একটা পা একটু তোলা, সোনার বাঘছাল, একহাতে ত্রিশূল অন্যহাতে ভিক্ষাপাত্র, কাঁধে ভিক্ষার ঝোলা। মা অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণার কাছে স্বয়ং বিশ্বনাথও কাশীতে ভিক্ষুক। বড় সুন্দর মায়েদের এই ভবময়ী মূর্তিগুলি। টানাটানা বড় বড় তিনটি চোখ, সম্পূর্ণ খোলা, অনিমেষ দৃষ্টিতে সন্তানদের দিকে চেয়ে আছেন। মুখে মৃদু হাসির রেখা। বছরের এই তিনটি দিন মায়ের এই স্বর্ণময়ী, অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তি সর্বসাধারণের জন্য অনাবৃতদ্বার থাকে। অন্যসময় প্রত্যহ পূজারী ওপরেই মায়ের পূজা করেন। যা সর্বসাধারণের অগোচর।
দেবী মহাগৌরী, বৃষভবাহনা চতুর্ভুজা, শ্বেতবর্ণা, শ্বেতবস্ত্রাবৃতা। অলংকারাদিও শ্বেতবর্ণের-শঙ্খবলয়, কণ্ঠ ও কর্ণের ভূষণও শঙ্খনির্মিত। শিরে রজত মুকুট। সদা অষ্টবর্ষা দেবী কুন্দপুষ্পের মাল্যধারিণী বিধুমুখী সদাপ্রসন্না। এঁর ঊর্ধ্ব দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল, নিচের দক্ষিণ হাতে অভয় মুদ্রা। বাম ঊর্ধ্ব হস্তে বরমুদ্রা, নিচের হাতে ডমরু।
এক পুরাণের মতে দেবী শিবের তপস্যার সময় অত্যন্ত কৃচ্ছ্রতার ফলে শীর্ণ ও কৃষ্ণকায়া হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর একটি নাম হয়েছিল অসিতা। পরে শিবের সঙ্গে বিবাহ হয়ে যাওযার পরে কোন এক সময় শিব দেবীর সেই কালো দেহবর্ণের জন্য উপহাস করে তাকে কালী বা কালোমেয়ে বলেছিলেন। এই কথা শুনে দেবী অভিমানে কৈলাস ছেড়ে চলে গিয়ে কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হলেন। সেই তপস্যার ফলে তাঁর দেহের কৃষ্ণ কোষ খুলে গিয়ে ভেতর থেকে এক দিব্যজ্যোতির্ময়ী রজতশুভ্রবর্ণা দেবীমূর্তি প্রকাশিত হলেন। বিদ্যুত্বর্ণা সেই দেবীই শিবের বাহন ও সব অস্ত্রাদি নিয়ে তাঁর কাছেই হাজির হলেন।শিবও অভিমানিনী দেবীর অভিমান ভাঙাতে ও তাঁর জন্য এতোদিন ব্যাকুল অপেক্ষায় থাকার পরে অপরূপা দেবীকে কাছে পেয়ে তাঁর নাম দিলেন মহাগৌরী-শুধু গৌরী নন।
আরেকটি মত আছে-শিব নিজেই সেই কৃষ্ণবর্ণা তপস্বিনীর বরতনু গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তাঁকেই বিদ্যুৎবর্ণা মহাগৌরী করে তোলেন।
অন্নপূর্ণা দেবীর কাশীর আবির্ভাব নিয়েও অনেক কাহিনী আছে। হিমালয়-পত্নী মেনকার গৃহে তখন কন্যা পার্বতী তাঁর স্বামীকে নিয়ে বাস করছেন। অবশ্য কৈলাসও হিমালয়ের অন্তর্গত যদি হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন কন্যা পিতাগৃহে আছেন। মায়ের মনে একটু ক্ষোভ-সে আর কতদিন বাপের বাড়ি থাকবে। এবার তো শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দরকার। নইলে প্রতিবেশীরা বদনাম করবে। তাই একদিন কন্যাকে ডেকে বললেন, ‘হাঁরে মেয়ে, আমার জামাই মহেশ্বরের ঠিকানা কী? সে থাকে কোথায়? তার বন্ধু-বান্ধব সব কারা? মনে হয় জামাইয়ের আত্মীয়স্বজন বা বাড়িঘর কিছুই নেই।’ কন্যা পার্বতী মায়ের এই কথা শুনে লজ্জা পেয়ে সময়মতো একরাত্রে স্বামী ভোলানাথ শংকরের কাছে মায়ের এই অণুযোগের কথা তুললেন, ‘হে কান্ত, হে নাথ! আজই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। তোমার নিজের কোন স্থান থাকলে আমাকে সেখানেই নিয়ে চলে।’ এই কথা শুনে দেবাদিদেবের বিশ্বনাথ সেইদিনই হিমালয় ছেড়ে দেবী পার্বতীকে সঙ্গে নিয়ে মর্ত্যে তাঁর আনন্দকাননে অবিমুক্ত পুরীতে এসে উপস্থিত হলেন।
পঞ্চক্রোশ পরিমিত এই স্থান শিবময়-‘কাশীকে হর কংকর হ্যায় ভোলা শংকর’। এর প্রতিটি নূড়িও শিবময়। শিবস্বরূপ। শিব স্বয়ং কাশী সৃষ্টি করে নিজের ত্রিশূলের ওপর সেটিকে ধরে রেখেছিলেন। তাই সেখানে পৃথিবীর কোন মলিনতার ছোঁয়া ছিল না। নিত্য আনন্দ বিরাজিত তাই এর নাম আনন্দকানন। জীব এখানে এসেই মরণ মাত্রই মুক্ত হয়। শিবক্ষেত্র মুক্তিক্ষেত্র -মহাশ্মশান-জীবের অন্তিম শয়ান স্থান। অন্তে মুক্তি পাওয়ার জন্য জীব এখানে মরতেই আসে। তাই এটি মহাশ্মশান। শিব তাঁর রুদ্র অনুচরদের নিয়ে এখানে নিত্য বাস করেন-তাই এটি রুদ্রাবাস। এই বিশ্বনাথের নিজের রাজ্যে এসে দেবী ভবানী ও বিশ্বেশ্বর পরমানন্দে বাস করতে লাগলেন। দুজনে এখানে কেমন করে থাকেন সেকথা কাশীখণ্ডে বলা হচ্ছে। কেমন তঁদের রূপ-‘ভালে লোচনম্ কণ্ঠে কালং বৃষধ্বজং বামাঙ্গসন্নিবিষ্টাদ্রিতনয়া চন্দ্রশেখরা। কপর্দ্দিনো বিরাজন্তং ত্রিশূলাজগবায়ুধং। স্ফুরৎ কর্পূর গৌরাঙ্গং পরিণদ্ধ গজাজিনম্ অর্কশতাধিকম্ শম্ভুম্ নমামি শ্রীচরণাজয়ো।।”
পার্বতীকে নিয়ে শিব তাঁর বিচিত্র বেশবাসে ঘুরে বেড়ান তাঁর রাজ্যের সর্বত্র। মাও খুশি নিজের আলয়ে এসে। এখানে তাঁর নাম ভবরানী বা ভবানী। তাঁর কাজ এখানে সমগ্র কাশীর অন্নভাণ্ডার রক্ষা ও অন্নদান। এই অন্ন শুধু জীবের শরীরের পরিপুষ্টির খাদ্যই নয়। তার পরমার্থ জ্ঞান দান ও আত্মার পরিপুষ্টিও এতে আছে। তাই কাশীখণ্ডে বলা হয়েছে, ‘সর্বেভ্যঃ কাশি-সংস্থেভ্যো মোক্ষ-ভিক্ষাং প্রযচ্ছতি।’ সমগ্র বারাণসী ও বিম্বের নাথ যিনি তিনিও একবার কোথাও অন্ন জোটাতে না পেরে মায়ের কাছে এসে ভিক্ষার পাত্র হাতে দাঁড়াতে বাধ্য হন। মানতে বাধ্য হন এখানে মা অন্নপূর্ণাই রাজরাজেশ্বরী। তাঁর ইচ্ছাতেই সব কিছু হয়-রয়-যায়। তাঁর কৃপাতেই সকলেই অন্ন-পানে পরিতৃপ্ত হয়। শিবও তার বাইরে নন। শাস্ত্রমতে-‘দর্বী স্বর্ণ বিচিত্ররত্নখচিতা দক্ষে করে সংস্থিতা পলান্নঘৃতা পুরিতম্। আর বামে কারণামৃতা পুরীতম্ স্বাদু পয়োধরী মাণিক্যচষকম্।’ দুই হাতে অমৃতময় পলান্ন ও কারণবারি পান করিয়ে মা মহাদেবকে সেদিন এতো আনন্দ দিয়েছিলেন যে ভোলানাথ পরিতৃপ্তির আনন্দে উদ্বাহু হয়ে ‘পীত্বা ভূত্বানন্দময়ং নৃত্যন্তং শশিশেখরম্’ নৃত্যে মেতে উঠেছিলেন। তাঁর সেই নৃত্যরত আনন্দবিহ্বল মূর্তিই সোনার অন্নপূর্ণা দর্শনের সময় উপরে দেখা যায়।