Increase Reset Decrease

কাশীর নবদুর্গা - দেবী সিদ্ধিদাত্রী

Deviসিদ্ধিদাত্রীর মন্দিরে ঢুকবার মুখেই ডানদিকে একটি ঘরে গর্তের মধ্যে শিবলিঙ্গ-প্রাচীন সিদ্ধেশ্বর মহাদেব। সাদা শ্বেতপাথরের লিঙ্গ। দেবীর ভৈরব। ছোট একটি ঘরে দেবীর বিগ্রহ। সামনে সামান্য একটু জায়গা রেলিং দিয়ে ঘেরা সেখানে দেবীর বাহন সিংহ দেবীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। দরজায় পরদা টাঙানো। অপূর্ব সুন্দর মূর্তি। কালো কষ্টিপাথরের বিগ্রহ। সিংহের পিঠে বসা চতুর্ভুজা দেবীর চারহাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম। ত্রিনয়না দেবীর চোখ তিনটি সোনার। নানা অলংকারে-মুকুটে মালায়সুন্দর করে সাজানো। বহুমূল্য বেনারসী শাড়ি পরানো প্রমাণ আকারের মায়ের মূর্তিদেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। “সিদ্ধ-গন্ধর্বযক্ষাদ্যৈঃ অসুরৈঃ অমরৈরপি/সেব্যমানা সদা ভূয়ৎ সিদ্ধিদা সিদ্ধিদায়িনী”। মায়ের সমস্ত কপাল জুড়ে লাল সিন্দূর সুন্দর করে লাগানো সাকে সোনার নথ। মুখখারি এত সুন্দর, চোখ ফেরানো যায় না।

সংসারী জীব দুরকমের। তাদের প্রার্থনাও দুধরনের। একজন ভগবানকে বলেন, আমাকে এই জগতেই সুখ-সাচ্ছন্দ্য ভোগ-আনন্দ দাও, অন্যের কাছে সম্মান দাও, নানা রকম বিভূতি ঐশ্বর্য দাও যাতে আমি ভক্ত বা সাধক হিসাবেও মর্যাদার হতে পারি। নানা অলৌকিক ক্ষমতা দাও-য়ার সাহায্যে জগতে অসাধ্য সাধন করে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারি।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ইত্যাদিতে অণিমা-লঘিমা ইত্যাদি এবং সর্বজ্ঞত্ত্ব-দূরদর্শন-দূরশ্রবণ-পরকায়প্রবেশ এই সব যোগবিভূতি বা সিদ্ধির কথা আছে। এমন অনেক সাধক আছেন যাঁরা ভগবত্শক্তির আরাধনা করেন এই সব যোগসিদ্ধির জন্যই। যথাশাস্ত্র সাধন করলে সাধক এই সব দুর্লভ সিদ্ধির অধিকারীও হতে পারেন। তবে এই ছোট্ট ‘তবে’ আছে। এই সিদ্ধিই মায়ের দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সিদ্ধির প্রলোভন বা মোহ সহজ নয়। এতেই আটকে গেলে মায়ের দরজা আর সে ভক্ত খোলা পায় না। এগুলোকে যোগশাস্ত্রে সাধন বিঘ্ন বলা হয়েছে। লোককে আকৃষ্ট করবার জন্য নানা জনমনোহারিণীশক্তি সাধকের থাকতে পারে, সেও এ মা সিদ্ধিদাত্রীর কৃপায়। অবশ্য ঠিক ঠিক বলতে গেলে এটা তাঁর ‘মায়ায়’ বলাই ভাল। দেবী সিদ্ধিদাত্রী অবোধ সন্তানকে ভুলিয়ে রেখেছেন তাকে ছেলেখেলা দিয়ে, তার মুখে রঙিন চুষিকাঠি দিয়ে নিজে দূরে সরে রয়েছেন। সাধ্য বস্তু ভুলিয়ে দেয় এই পার্থিব সিদ্ধির মোহ। দেবী সিদ্ধিদাত্রীর এও এক লীলা! যে তাঁকে চায় সে তাঁকে পায়, যে তাঁকে না চায় তাকে পঞ্চভূতে নাচায়”। আর এই পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে কত ‘ব্রহ্মা বিষ্ণু খাচ্ছে খাবি’। সাধারণ মানুষ এই সিদ্ধিকে দেখেই সিদ্ধকে বিচার করে সে কত উঁচু সাধক। মা সিদ্ধিদাত্রীর দেওয়া ঐ জাগতিক বাসনা-কামনা ও উচ্চাভিলাষ প্রার্থনা না করে তাঁর কাছে চাইতে হয় সেই চরম ও পরম বস্তু। আত্মজ্ঞান-পরাভক্তি। সর্বকামাবসায়িতা।

অসুর-যক্ষ-গন্ধর্ব-দেবতা-ঋষি-নর সকলেই এই পদ্মাসীনা স্বর্ণবর্ণা রক্তবস্ত্রধারিণী চতুর্ভুজা দেবীর করুণাঘন দৃষ্টির সামনে নতজানু হয়ে জানায় যার যার মনের কামনা। সিদ্ধিদাত্রী দেবীর কাছে যার যেমন যোগ্যতা যেমন আধার সে তাই চায়। গীতাতে যেমন ভগবান বলেছেন-‘যে যথা মাংপ্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্’ যে আমাকে যেমন ভাবে চায় আমি তাকে সেইভাবে পরিতৃপ্ত করি। জননী সিদ্ধিদাত্রীও তাই। সন্তানের খিদে না মিটলে তাকে জোর করে অন্য কিছু দেওয়া যাবে না। তাই তিনি জীবকে ভোগও দান করেন মোক্ষও দান করেন। মহাভারতের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দেবী ভগবতীর কাছে জয়ের জন্য,সিদ্ধির জন্য প্রার্থনা করতে বলেছিলেন। রামায়ণে ব্রক্ষা রামচন্দ্রকে অকাল বোধনে দেবী ভগবতীর পূজা করিয়ে রাবণবধের সিদ্ধি প্রার্থনা করিয়েছিলেন। সমস্ত মার্কণ্ডের পুরাণে বিপর্যস্ত পরাজিত দেবতারা যুদ্ধজয়রূপ সিদ্ধির জন্য মায়ের বন্দনা করেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রী করুণাময়ী জননীও আর্ত সন্তানের আর্তিতে ব্যাকুলতায় প্রকট হয়ে সেই সংগ্রামে তাঁদের সিদ্ধ করেছেন, আবার অনেক সাধক ব্যক্তি-জীবনের নানারিপুর সংগ্রামে আর্ত ব্যথিত হয়ে দেবীর শরণ নিয়ে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা জানায় দেবী যেন সেই সাধকের সামনে থেকে তাঁর মায়াজাল সরিয়ে নিয়ে তাকে তাঁর স্বরূপ দর্শন করিয়ে সিদ্ধ করেন। সুতরাং এ জগতে সকল প্রকার জীবই জীবনের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের জন্য এই জগদম্বা জগজ্জননী সিদ্ধিদাত্রীর কৃপাপ্রার্থী। সে জেনে হোক বা না জেনে হোক। অর্থাৎ জীবের সকল কর্মের সর্বপ্রকার সিদ্ধি বা জয় যিনি দান করেন-তিনিই সিদ্ধিদাত্রী। বুদ্ধিমান জ্ঞানী সাধকের তাই তাঁর চরণে আকুল প্রার্থনা: মা, কৃপা করে সিদ্ধিদার উন্মোচন করো, যাতে তোমার কৃপায় তোমার মায়ের আবরণ সরিয়ে তোমার-আমার স্বরূপ আমি উপলব্ধি করতে পারি। মানুষ জীবন যেন সার্থক হয়। মা কিছুই জানি না, একমাত্র তোমার কৃপাই সম্বল আমার”-
“ন মন্ত্রং নো যন্ত্রং তদপি চ ন জানে মূর্তিমহো
ন চাহবানং ধ্যানং তদপি চ ন জানে ¯ত্ততিকথাম।
ন জানে মুদ্রাস্তে তদপি চ ন জানে বিপালনম্
পরং জানে মাতস্ত্বদনু-শরণম্ ক্লেশহরণম্”।

Print