আদ্যা শক্তি তত্ত্ব

পরব্রহ্মের পট্টমহিষী ব্রহ্মশক্তি তত্ত্বত ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। কিন্তু লীলায় বিশ্বের সেই উপাদান-কারণ ও নিমিত্ত-কারণ কার্যরূপে প্রকাশিত হন তাঁর গুণময়ী মায়াকে অবলম্বন করে। এই মায়াই তন্ত্রের মহামায়া। তিনিই আদিশক্তি - পরমাপ্রকৃতি। নির্গুণ ব্রহ্মের গুণময়ীরূপ। নিরাকার তত্ত্বের সাকার আকার । ইনিই সাধকের প্রার্থনায়, ভক্তের আর্তিতে সন্তানের বিপদে আবির্ভূতা হন রূপময়ী হয়ে-ধ্যানের বিগ্রহ হয়ে। বৈদিকযুগে ইনিই হৈমবতী উমা,দেবীসূক্তের ব্রহ্মবিদুষী বাক্, শরীরধারিণী আদ্যাশক্তি। পৌরাণিক যুগে ইনিই দেবতাদের বিপদে তাঁদের আকুল আর্তির সম্মিলিত বিগ্রহ হয়ে মূর্ত হন এত অপরূপা বহুভুজা নানা অলংকার-অস্ত্রাাদিশোভিতা দিব্য নারীমুর্তিতে। সন্তানের আহ্বানে, দেবানাং কার্য্যসিদ্ধ্যর্থং আবির্ভবতি । বারবার তিনি নানারূপে নানা নামে স্বর্গের সন্তাদের রক্ষার জন্য ও দুষ্কৃতি দৈত্যদের বিনাশ তথা মুক্তি দেওয়ার জন্য অবতীর্ণা হন। আবার মর্ত্যবাসী ব্যাকুল সাধক ভক্তদের জন্যও, সাধকানাং হিতার্থায় অরূপা রূপধারিণী।’ সেই অরূপা-মহামায়া ভক্তের মনোময়ী আরাধ্যা দেবী হিসাবে প্রকটিত হন তার হৃদয়পদ্মে। যে তাঁকে যেমনভাবে আরাধনা করতে চায়, দেখতে চায়,পেতে চায়,তার কাছে তিনি তাই হন - মায়য়াবহুরূপিণী’ তাইতো সাধক কবি বলেন, সাধকের বাঞ্ছা পূর্ণ কর নানা রূপধারিণী দেবীর এই রূপকল্পনা সাধকের সাধনায় পরমাপ্রাপ্তি।
সৃষ্টিস্থিত্যন্ত -কারিণী জগদ্ধাত্রী যিনি - তিনিই করুণায়,স্নেহে,কৃপায় ভক্তের ভক্তির ডোরে ধরা দেন।

তন্ত্রগ্রন্থে এই আদ্যাশক্তির বিচিত্র লীলা-বিলাসের কথা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে তাঁর দুটি রূপের কথা। একটিতে তিনি অসুরসংহারিণী, ভীমাভয়ঙ্করী, লোলজিহ্বা-রক্তনয়না, দিগম্বরী এলোকেশী, বহু অস্ত্র-শস্ত্রধারিণী রুদ্রণী। তাঁর ওই ভীষণামূর্তি সন্তানের ত্রাণের জন্যই। আর একটি বিগ্রহে তিনি সৌম্যাসৌম্যতরাশেষ সৌমেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী’, করুণাময়ী, প্রসন্নবদনা, অনায়স্তাননা দেবী স্নিগ্ধ চন্দ্রাননা-অপূর্বরূপ-লাবণ্যময়ী জননীমূর্তি। এখানেও তিনি মুক্তিহেতু-ভূতা সনাতনী। সন্তানকল্যাণ-কামনায় সদাকৃপাসুমুখী । এই দুই রূপের নানা অভিব্যক্তিতে নানা নামে প্রাচীন যুগে ঋষিদের ধ্যানে তিনি ধরা দিয়েছেন। যিনি পার্বতী-সতী-উমা,দেবতাদের সম্মিলিত আহ্বানে তিনিই কখনও ভীষণা-দানবদলনী-চতুর্ভূজা-কালিকা,কখনও দশভুজা অষ্টাদশ-ভুজা-সহস্রভুজা দেবী মহিষমদির্নী, ভগবতী দুর্গা কৌষিকী। কখনও প্রসন্না মূর্তি সিংহাসন জগদ্ধাত্রী, কখনও বা অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণা। কখনও ধনধান্যাধিষ্ঠাত্রী শ্রীময়ী মহালক্ষ্মী,কখনও সর্বশুক্লা-বিদ্যাবিজ্ঞানদাত্রী চতুঃষষ্ঠী-কলাময়ী দেবী বাগ্বাদিনী সরস্বতী। কখনও রোগমহামারী ত্রাণকর্ত্রী দেবী শীতলা, কখনবা পুত্রদা দেবী ষষ্ঠী। এসব তাঁরই লীলাবৈচিত্রে সাধকের ধ্যানে তার কল্যাণে মর্ত্যে সৃষ্ট বহুরূপ।

এছাড়াও বিচিত্ররূপিণী,নানা অঘটন ঘটন পটিয়সী দেবী মহামায়া স্বেচ্ছায় নিজ শরীর থেকে সৃষ্টি করেন আরও বহু লীলাবিগ্রহ। ‘জগৎউদ্ধার হেতবেও সন্তানদের’ মঙ্গলকামনায় একা তিনি বহু হন ;‘কখনও শ্বেত,কখনও পীত,কখনও নীল লোহিত রে।’ দেবী ভগবতীর বিশেষ পূজায় দেবীর এই সব সহচরীশক্তি মূর্তিদের আবহিন করে পূজা করতে হয়। এঁরা হচ্ছেন -কালী তাঁরা প্রভৃতি দশমহাবিদ্যা; জয়ন্তী মঙ্গলাদি একাদশ শক্তি; ব্রহ্মা-বিষ্ণু -মহেশ্বরাদির ক্রিয়াশক্তি -ব্রহ্মাণী,মাহেশ্বরী বৈষ্ণবী প্রভৃতি আষ্টশক্তি; উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডাদি দেবীর রণাঙ্গনে নিত্যসহচরী; শৈলপুত্রাদি নবদুর্গা; কালিকাদি চতুষষ্ঠী যোগিনী; কোটিযোগিনী ইত্যাদি।

এছাড়াও ভারতের নানা তীর্থে তীর্থ-স্বরূপিণী হয়ে বিরাজিতা একই আদ্যাশক্তি কখনও কামরূপিনী কামাখ্যা, কখনও চিরকুমারী তপস্বিনী দেরী কুমারী,কোথাও মীনাক্ষী,কখনও বা কামাক্ষী, কোথাও বিশালাক্ষী,কোথাও বা অন্নদাত্রী পরম-করুণাময়ী অন্নপূর্ণা ভবানী। এইসব একই দৈবশক্তির নানা নামে,নানা রূপে প্রকাশ। এছাড়াও প্রকৃতির বৃক্ষলতার মধ্যেও নানাভাবে তিনি বিরাজিতা। দুর্গাপূজায় আমরা যাকে কলাবৌ বলি সেই নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা নামেও তিনি পূজিতা হন ।

এই ভক্তাভীষ্টদায়িনী দেবী নিজেই বলেছেন -তেমরা যা চাইবে “মত্তঃ তৎ প্রাপ্যতাং সর্বং পরিতুষ্টা দদামিতৎ’’ । কিন্তু এই বহুরূপা-নানা ভাবধারিণী দেবী মূর্তিগুলি সবই তাঁর ঐশ্বর্য-বৈভব। লীলায় তিনি বহু হন। তত্ত্বতঃ তিনি অনন্যা,অদ্বিতীয়া,অপরিমেয়া । তিনি নিজেই সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন এক জিজ্ঞাসু মদগর্বী দানবসন্তানের প্রশ্নের উওরে, ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা?’ আমি-আমিই মাত্র আাছি এ জগতের কর্ত্রী কারয়িত্রী-করণগুণময়ী কর্মহেতু স্বরূপা। আমিই এই জগতের আদি, ব্রহ্মাদি যত রূপ সবই আমার সৃষ্টি। মহাকাল আমারই নিয়ন্ত্রণে, আমি প্রলয়কালে সেই কালকেও গ্রাস করি তাই তো আমি মহাকালী। আর এই যে সব নানা বিচিত্র রূপে আমার সহচারিণী ও অন্যত্র প্রতিষ্ঠিতা শক্তি বিগ্রহ এইসব আমারই বিভূতি,‘মৎ বিভূতয’ ।

অভয়দায়িনী দেবী জগদম্বা-করুণার্দ্রাহ্দৃয়া দেবী তাঁর সন্তানদের প্রতি সদয়া হয়ে তাদের আশ্বস্ত করেন-“ ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি। তদাতদাবতীর্য্যাহং করিষ্যামি অরিসংক্ষয়ং ’’। ‘যখন যখনই এই আসুরিক উত্পাতে আমার সন্তানেরা কাতর হয়ে আমার শরণ নেবে তখন তখনই আমি আবির্ভূত হয়ে তাদের রক্ষা করব’। আর ভরসার কথা,এই বর্তমান যুগের মানবদের কথাও স্মরণ করে তিনি বলেছেন -‘ত্রৈলোকস্য হিতার্থায়’-ত্রিলোক-স্বর্গ-মর্ত্য ও পাতালবাস দের আহ্বানেও তিনি আসবেন । ‘যশ্চ মর্ত্ত্যঃ স্তবৈরেভিস্তাং স্তোষ্যত্যমলাননে । তস্য বিত্তর্ধি বিভবৈর্ধনদারাদি-সম্পদাম। বৃদ্ধয়েহস্মৎ প্রসন্না ত্বং ভবেথাঃ সর্বদাম্বিকে।” আমাদের মতো অর্থাৎ দেবতাদের মতো মর্ত্যমানবের প্রতিওকৃপাসুমুখী হয়ে তুমি তাদের অভীষ্ট সব কিছু দান করে তার প্রতিও প্রসন্না থেকো। দেবতারা মায়ের কাছে মর্ত্যবাসীর জন্য এই আশীর্বাদও চেয়ে নিয়েছেন।

Print