
স্কন্দমাতা
দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটেছিল এক বিশেষ মুহূর্তে। যখন মহিষাসুরের প্রচণ্ড প্রতাপে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল স্বর্গরাজ্যে-যখন দেবতাদের বিনাশ করে দেওয়ার প্রবল প্রতাপ দেখিয়েছিল মহিষাসুর। সেই মহিষাসুরের প্রচণ্ড অত্যাচারে দেবতারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরাজিত হয় দেবকুলের সৈন্যরা। ফলে দেবতারা ক্রুদ্ধ হন। তখন দেবতাদের সকলের মুখ থেকে নির্গত হয় তেজ। সেই দেবতেজপুঞ্জ জ্যোতিঃ বা সম্মিলিত শক্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এক জ্যোতির্ময়ী নারীমূর্তি। সেই নারীমূর্তিই হল শুভ-শক্তির প্রতীক। যিনি এই অশুভরূপ আসুরিক শক্তি বিনাশিনী। মহিষাসুর নামক অসুরকুলকে যিনি ধ্বংস করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
পুরাণে কথিত আছে, দেবতাদের দেহ-নিঃসৃত তেজোরাশি থেকে এক অপরূপ নারীমূর্তির সৃষ্টি হয়। সেই তেজোময়ী নারীর দেহের দিব্যকান্তি ত্রিলোকে পরিব্যাপ্ত হয়। দেবতারাই এক-একজন দেবীর এক-একটি অঙ্গ গঠিত হয় এবং সমস্ত তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে সেই দিব্য নারীমূর্তি গঠিত হয়েছিল। যেমন, দেবাদিদেব মহাদেব স্বয়ংম্ভুর তেজ থেকে দেবীর উজ্জ্বল মুখশ্রী গঠিত হয়; যমরাজের তেজ থেকে দেবীর কেশরাশি নির্মিত হয়। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর তেজ থেকে দেবীর বলিষ্ঠ বাহুসমূহ নির্মিত হয়, চন্দ্রের তেজ থেকে দেবীর পীনোন্নত স্তনযুগল গঠিত হয়, দেবরাজ ইন্দ্রের তেজ থেকে দেবীর দেহের মধ্যভাগ সৃষ্টি হয়, বরুণদেবের তেজ থেকে দেবীর জঙ্ঘা ও ঊরুদ্বয় নির্মিত হয়, ভূ-দেবীর তেজ থেকে দেবীর নিতম্বদেশ তৈরি হয়, স্রষ্টা ব্রহ্মার তেজ থেকে দেবীর অক্লান্ত পদদ্বয় গঠিত হয়, সূর্যের তেজ থেকে দেবীর পায়ের আঙুলগুলি তৈরি হয়, বসুগণের তেজ থেকে দেবীর উন্নত নাসিকা গঠিত হয়, প্রজাপতির তেজ থেকে দেবীর শ্বেতশুভ্র দন্তসমূহ নির্মিত হয়, অগ্নিদেবের তেজ থেকে দেবীর নয়নত্রয় নির্মিত হয়, সন্ধ্যাদেবীর তেজ থেকে দেবীর ভ্রূ-যুগল গঠিত হয়। পবনদেবের তেজ থেকে দেবীর কর্ণদ্বয় সৃষ্টি হয় এবং অন্যান্য দেবতার তেজ থেকে দেবীর দেহের অন্যান্য অংশগুলি গঠিত হয়। অর্থাৎ সমস্ত দেবতাদের তেজোরাশির সংমিশ্রণে উত্পন্ন হয়েছিল এই নারীমূর্তি।
সেই তেজোময়ী দেবীকে দেবতারা তখন একে একে তাঁদের নিজস্ব অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে তুললেন রণরঙ্গিণীর মূর্তিতে। প্রথমেই দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর নিজস্ব শূল থেকে আর একটি শূল সৃষ্টি করে দেবীকে উপহার দিলেন। দেবী সেই তেজোময় শূল ও চক্র হস্তে ধারণ করলেন। বরুণদেব দেবীকে দিলেন শঙ্খ। হুতাশন কর্তৃক প্রদত্ত হল শক্তি। পবনদেব ধনুক ও বাণপূর্ণ তূণ প্রদান করলেন দেবীকে। দেবরাজ ইন্দ্র নিজের বজ্র থেকে একটি বজ্র উত্পন্ন করে দেবীর এক হাতে দিলেন, আর এক হাতে ঐরাবত গজের গলার ঘন্টা থেকে উত্পন্ন করে দেবীকে একটি তেজোময় ঘন্টা প্রদান করলেন। তা দেখে যমরাজ কালদণ্ড থেকে একটি দণ্ড উত্পন্ন করে দেবীকে সেটি উপহার দিলেন। সমুদ্র দিলেন পাশাস্ত্র। প্রজাপতি ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু। এভাবে দেবীকে সকল দেবতা এক-একটা অস্ত্র প্রদান করলেন। স্বয়ং দেব-দিবাকর সূর্য নিজের রশ্মির অনুরূপ রশ্মি থেকে তেজোময় রশ্মি প্রদান করলেন দেবীর সমস্ত রোমকূপে। ভগবান কাল নির্মল খড়্গ ও চর্ম প্রদান করলেন দেবীকে। ক্ষীরোদ সমুদ্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা নির্মল হার, অক্ষয় বস্ত্রযুগল, চূড়ামণি, দিব্যকুণ্ডল, কটক এবং শুভ্র অর্ধচন্দ্র অর্পণ করে দেবীর সর্ববাহুতে কেয়ূর প্রদান করলেন। তারপর দেবীর পদযুগলে নির্মল নূপুর, গলায় দিলেন হার এবং হাতের প্রতিটি আঙুলে পরিয়ে দিলেন অঙ্গুরীয়। স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবীর হাতগুলিতে নির্মল পরশু, নানাবিধ অস্ত্র এবং অভেদ্য চর্ম প্রদান করলেন। সমুদ্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা দেবীর মস্তকে ও ব্রহ্মদেশে একটি একটি করে অম্লান পদ্মের মালা এবং তাঁর হাতে একটি অতি মনোরম পদ্ম প্রদান করে সম্মানিত করলেন। হিমালয় পর্বত দেবীকে বাহনরূপে একটি সিংহ ও ভূষার্থ একটি রত্ন প্রদান করলেন। ধনাধিপতি কুবের প্রদান করলেন একটি সদা-সুরাপূর্ণ পানপাত্র। পৃথিবীর ভার যাঁর মস্তকে ন্যস্ত সেই নাগাধিপতি শেষ মহামণি-বিভূষিত একটি নাগহার দেবীকে অর্পণ করে বিভূষিত করলেন। অন্যান্য দেবতাগণ বহুবিধ অস্ত্র, অলঙ্কার দিয়ে দেবীকে ভূষিত করলেন। দেবী যেন কোন রণমত্তা দিব্যাঙ্গনা। সমস্ত অস্ত্রে, অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে ধারণ করলেন তেজোময়ী রূপ। তিনিই হলেন দেবী দুর্গা।