
আদ্যাশক্তির মহিমা
সপ্তশতী শ্লোকাত্মক চণ্ডীতে দেবী ভগবতীর বহুরূপের কথা জানা যায়। বিভিন্ন প্রয়োজনে দেবী নানা রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। কিন্তু তত্ত্বতঃ তিনি একা-অদ্বিতীয়া-‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।’ নিজের ঐশ্বর্য্যবলেই তিনি বহুরূপে প্রতীয়মানা-‘অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা।’
সকাম ভক্ত এই চণ্ডীপাঠে বহু সুখ সমৃদ্ধি ও ভোগ লাভ করে। আর নিষ্কাম ভক্ত চণ্ডীতত্ত্বের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে মুক্তিলাভ করে। অর্থাৎ এই শাস্ত্রপাঠে পাঠক ভক্তি-মুক্তি-অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়স, ভোগ-অপবর্গ যা চায় তাই পায়। ‘আরাধিতা সৈবনৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা।’ ‘সাহযাচিতা চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতি।’
বৈদিক যুগেও এই আদ্যাশক্তির মহিমা কীর্তিত হয়েছে। ঋক্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫ সংখ্যক সূক্তটিই দেবী আদ্যাশক্তি ভগবতীর স্বরূপ ও মহিমা প্রকাশক। সূক্ত শব্দের মানে সু-উক্ত, বিশেষ ভাবে, ভালো ভাবে যেটি বলা হচ্ছে তাই সূক্ত। বৈদিক স্তোত্রাদিকে সূক্ত বলা হয়। এটিকে দেবীসূক্ত বলে। সায়নাচার্য এই সূক্তটির মন্ত্রদ্রষ্ট্রী ঋষি ব্রহ্মবিদূষী বাক্ সম্পর্কে বলেছেন। মহর্ষি অম্ভৃণতনয়া বাক্ সচ্চিদানন্দস্বরূপ সর্বব্যাপী পরমব্রহ্মের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা উপলব্ধি করে সমস্ত জগৎ ও সকলের আশ্রয় রূপে নিজেকেই অনুভব করেছেন। অথবা শুদ্ধ আধার ব্রহ্মবিদুষী বাক্কে আশ্রয় করে স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপিণী আদ্যাশক্তি ভগবতী তার মধ্যে দিয়ে স্বয়ংই নিজের স্বরূপের পরিচয় দিয়েছেন। এই দেবীসূক্তেই চণ্ডীর দৈবী মাহাত্ম্য বীজাকারে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
একাদশ রুদ্র-অষ্টবসু-দ্বাদশ আদিত্য-ত্রয়োদশ বিশ্বদেবতা, দিন ও রাত্রির দেবতা মিত্র-বরুণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়-এই সব বৈদিক দেবতাদের রূপে আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতিই বিরাজ করেন। তিনিই এইসব দেবতাদের আত্মার স্বরূপ। সমস্ত দেবতা তাঁরই অনন্ত শক্তির প্রকাশ মাত্র। তিনিই সর্বদেবদেবীরূপে বিরাজিতা, তিনিই জগদীশ্বরী, তাঁর শক্তিতেই ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টি-স্থিতি ও লয় হয়। সাধকদের তিনিই লৌকিক ও অলৌকিক, পার্থিব ও অপার্থিব সম্পদ দান করেন। ভোগ ও মোক্ষ দান করেন। সকলের অভিলষিত যে আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান, দেবী সেই ব্রহ্মবিদ্যা-স্বরূপিণী।
দেবীসূক্তে তিনি বলেছেন, আমি একা অদ্বিতীয়া হয়েও বহুরূপে জগদাকারে নিজেকে বিকাশ করেছি। সেই যে আমি তাঁকেই দেবতারা সর্বত্র পূজা করেন।’ বিশ্বজননী আদ্যাশক্তি নিজের বিরাট মূর্তির কথা নিজ মুখে এখানে বললেন। তিনি বলছেন, ‘আমিই যাকে যেমন ইচ্ছা করি তাকে তেমনি ভাবেই সৃষ্টি করি।’ ব্রহ্মা বা ব্রহ্মজ্ঞ সব আমার ইচ্ছাতেই হয়। রুদ্রের শক্তিও আমি। ধর্মরক্ষার জন্য অসুর বিনাশ করে সাধুদের আমি রক্ষা করি।’ গীতাতে যেমন ভগবান বলেছেন, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্/পরিত্রাণায় সাধুনাম বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম/ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’ ঠিক তেমনি আদ্যাশক্তি মহামায়াও যুগে যুগে ধর্ম ও ধার্মিকদের রক্ষা করার জন্য অবতীর্ণা হন। তিনি সর্বব্যাপী। দ্যুলোক-ভূলোক সব কিছু সৃষ্টি করে তাতেই অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন। তাঁকে, সেই ব্রহ্মময়ীকে সাধকের শুদ্ধ বুদ্ধির সূক্ষ্ম বুদ্ধির দ্বারা প্রকাশ করা যায়। অথবা তিনি ঐ সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন সাধকের হৃদয়ে নিজেকে প্রকাশিত করেন। শাস্ত্রে যেমন বলা হয়েছে, ‘দৃশ্যতে তু অগ্রয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ।’ এই আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতি যদিও তত্ত্বত অসঙ্গা নির্বিকারা ব্রহ্মচৈতন্যস্বরূপা তবুও নিজ শক্তিবলে তিনিই জগৎ রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। সেই আদ্যাশক্তি সূক্ষ্মা, স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত স্বরূপিণী। নিরাকারা হয়েও সাকারা। তিনি কৃপা না করলে কে তাঁকে জানতে পারে? তন্ত্রে তাই বলা হয়েছে, ‘ত্বমেব সূক্ষ্মা স্থূলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী/নিরাকারাহপি সাকারা কস্ত্বাং বেদিতুমর্হমি।’