Increase Reset Decrease

কাশীর নবদুর্গা - দেবী ব্রহ্মচারিণী

Devi Brahmachariniবেণীমাধব ঘাটের সামান্য উত্তরে। অত্যন্ত সংকীর্ণ গলি গিয়ে শেষ হয়েছে গঙ্গার ধারে। এই মন্দিরকে চেনবার উপায় দরজার মাথার ওপর শ্বেতপাথরে লেখা আছে নবদুর্গার অন্যতম ছোটি দুর্গাজী -ব্রহ্মচারিণী। আর দেওয়ালের গায়ে আচার্য শংকরের দেবী অপরাধ ক্ষমাপন স্তোত্রের কিছু অংশ -
“ন মোক্ষাস্যাকাঙ্খা ন চ বিভববাঞ্ছাহপি চ ন মে।
ন বিজ্ঞানাপেক্ষা শশিমুখি সুখেচ্ছাপি ন পুনঃ।
অতস্ত্বাং সংযাচে জননী জননং যাতু মম বৈ।
মৃড়ানী রুদ্রণী শিবশিবভবানীতি জপতঃ।।”
-হে জগদম্বে,আমার ধন-জ্ঞান-বিষয়,এমনকি মুক্তিরও কোনো বাসনা আর নেই। শুধু একটিমাত্র ইচ্ছা আমার, মৃড়ানী-রুদ্রাণী-শিব-শিবভবানী-নাম জপ করতে করতেই আমার জীবন যায়।

একটি দশ-বারো হাত লম্বা, তিন-চার হাত চওড়া লম্বাটে ঘর। তারই একপাশে, প্রধান দরজার ঠিক গায়েই ফুট দুয়েক উঁচু একটি পেতলের রেলিং-ঘেরা ছোট বেদী। তিন-চার হাত লম্বা-চওড়ার বেশি গর্ভমন্দির বলে কিছু নেই। এই ছোট বেদীর উপর পূর্বাস্যা একটি ছোট ধাতুমূর্তি মায়ের। সর্বাঙ্গ রক্তবস্ত্রবেষ্টিতা। হাত খানেক উঁচু বিগ্রহ। মুখে সোনার মুখোশ লাগানো-যেমন এদেশের প্রায় সব দেবদেবীর থাকে। ছোট হলেও খুব সুন্দর মূর্তি। দেবী দণ্ডায়মান পদ্মের ওপর। দক্ষিণ হাতে জপমালা নিয়ে জপ করছেন আর বাম হাতে কমণ্ডলু। আলুলায়িত কুণ্ডলা। ভারি সুন্দর করুণাময়ী মুখশ্রী। ইনিই দেবী ব্রহ্মচারিণী। শরৎ ও বাসন্তী শুক্লা দ্বিতীয়ায় দর্শনের দেবী। “দধানা করপদ্মাভ্যাম্ অক্ষমালা কমণ্ডলু। দেবী প্রসীদতু ময়ি ব্রহ্মচারিণ্যনুত্তমা” জপমালা ও কমণ্ডলু-ধারিণী দেবী,অণুপমা ব্রহ্মচারিণী জননী,তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও।

দেবী শিবকে পতি হিসাবে পাওয়ার জন্য হিমালয়ে যখন কঠোর তপস্যা করেছিলেন,তখনকার তপস্বিনী মূর্তি এটি। ব্রহ্ম শব্দের একটি অর্থ তপস্যা। তপের বা তপস্যার আচরণকারিণী তাই ব্রহ্মচারিণী। বলা হয় “বেদস্তত্বং তপব্রহ্ম"বেদ, তত্ত্ব আর তপ ব্রহ্মের অর্থ। ব্রহ্মতত্ত্ব চিন্তাময়ী, তপস্বরূপিনী দেবী অম্বিকা পার্বতীর এই তপোময়ী মূর্তিই ব্রহ্মচারিণীর স্বরূপ। ঐ কল্পে শিবকে পতি হিসাবে পাওয়ার জন্য তিনি আহার-নিদ্রা সংযম করে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। এমনকি গলিত পত্রও তিনি গ্রহণ করেননি আহার্য হিসাবে। তাই তখন তাঁর নাম হয়েছিল অপর্ণা। তাঁর এত কঠোর তপস্যা দেখে মাতা মেনকা মিনতি করে বলেছিলেন-‘উ-মা’,আর নয় মা,এতো কষ্ট কোরো না। তখন তার প্রসন্ন হয়ে চন্দ্রমৌলিশ্বর মহাদেব প্রথমে মদন ভস্ম করেন, তারপর তার চিরসঙ্গিনী দেবী পার্বতীকে পত্নীত্বে বরণ করেন। দেবী পার্বতীর সেই হিমালয়ের ব্রহ্মচর্যব্রতধারিণী বিগ্রহের স্মরণে এই নবদুর্গার দ্বিতীয়ায় নাম হয়েছে ব্রহ্মচারিণী।

পুরাকালে দেবতাদের অসুরদের সঙ্গে সংগ্রামে জয়লাভের পর অহংকার হয়েছিল, কেনোপনিষদে সেই কাহিনী আছে। তাঁরা ভেবেছিলেন,আমরাইনিজেদের শক্তিতে জয়লাভ করেছি। তাঁরা অহংকারে ভুলে গিয়েছিল সর্বকর্মের কর্ত্রীকে। তাঁদের এই ভ্রান্তি দূর করবার জন্য স্বয়ং উমা হৈমবতী বহু শোভমানা উজ্জ্বল মূর্তিতে আবির্ভূব হয়ে তাঁদের শক্তি পরীক্ষা করে,তাঁরা যে কত সামান্য শক্তির আধিকারী তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেন এবং শেষে কৃপা করে ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে ইন্দ্রকে বুদ্ধি দিলেন যাতে তাঁরা বুঝতে পারলেন সমস্ত জ্ঞানের মূলে সেই আদি ব্রহ্মতত্ত্ব। সকল শক্তির উত্স পরব্রহ্ম। আর দেবী হৈমবতী মূর্তিমতী ব্রহ্মজ্ঞানময়ী-ব্রহ্মস্বরূপিণী-জ্ঞানেচ্ছা ক্রিয়াময়। ব্রহ্মচর্যই সমস্ত জ্ঞানের শক্তি। “ব্রহ্মচারয়িতুম্ শীলমস্যাঃ।” ব্রহ্মজ্ঞান দান,ব্রহ্মকে প্রাপ্ত করানো যাঁর স্বভাবে তিনিই দেবী ব্রহ্মচারিণী।

Print