IncreaseReset Decrease

দেবী জয়ন্তী

দেবী দুর্গার হাজারো নাম। তন্মধ্যে শ্রী শ্রীচণ্ডীতে প্রথমেই বলা হয়েছে :
‘জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তু তে।। (অর্গলাস্তোত্র, ২)
-অর্থাৎ, হে দেবী! তুমি জয়ন্তী (জয়যুক্তা), মঙ্গলা (জন্মাদিনাশিনী), কালী (সর্বসংহারিণী), ভদ্রকালী (সুখপ্রদায়িনী), কপালিনী (কপাল হস্তে বিচরণকারিণী), দুর্গা (দুঃখপ্রাপ্যা), শিবা (চিত্স্বরূপা) ক্ষমা (করুণাময়ী), ধাত্রী (বিশ্বধারিণী), স্বাহা (দেবপোষিণী) এবং স্বধা (পিতৃতোষিণী)-রূপিণী, তোমাকে নমস্কার।
দেবীর এক নাম জয়ন্তী। অর্থাৎ তিনি বিজয়িনী। সদা-সর্বদা জয়যুক্তা। তাঁর জয় অবধারিত। যুদ্ধে তিনি অপরাজিতা। কোনো যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটেনি। জয় তাঁর অবশ্যম্ভাবী। সেইজন্যই তিনি জয়ন্তী।
জন্মসূত্রে জয়ন্তী ঋক্বেদের প্রধান ও শক্তিশালী এক বিরাট দেবতা ইন্দ্রের দুহিতা। দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তাঁর পত্নীর নাম ইন্দ্রাণী। দুই পুত্র জয়ন্ত ও ঋষভ। জয়ন্তর ভগ্নী জয়ন্তী।
সুর-অসুরের যুদ্ধের সময় তাঁর বিশেষ আবির্ভাব ঘটে। একবার দানবরা দেবতাদের কাছে যুদ্ধে হেরে যায়। তখন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য রাগে-ক্ষোভে দেবতাদের প্রতি প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রস্তুত হন এবং কৈলাসে গিয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনা করতে থকেন। দানবরাজও মনে মনে ভাবেন, যদি শিবকে একবার তপস্যায় তুষ্ট করা যায়, তাহলে সকল শক্তি করতলগত হবে। তাই দৈত্যাচার্য শুক্র সদাশিবের ধ্যানে গভীরভাবে মগ্ন হলেন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র গোপনসূত্রে এ খবর পেয়ে যান। কি বিপদ! মহাদেব যদি একবার দৈত্যকে বর দেন, তাহলে তাঁকে যুদ্ধে হারায় কার সাধ্য? না যে কোনো প্রকারে তাঁর এ ধ্যান ভাঙাতেই হবে! নইলে দেবতাদের রক্ষা নেই!
তখন ইন্দ্রদেব ভেবে-চিন্তে ঠিক করেন, তাঁর কন্যা জয়ন্তীকে পাঠাবেন শুক্রাচার্যের সেবিকা হিসাবে, যাতে তাঁর সকল তপস্যা ভঙ্গ হয়। এ প্রস্তাবে দেবী জয়ন্তী গররাজী হন। অবশ্য অবশেষে পিত্রাদেশ লঙ্ঘন না করে দেবী জয়ন্তী দৈত্যগুরুর সেবা করতে সম্মত হন। কিন্তু জয়ন্তী পিতৃনির্দেশ মতো শুক্রাচার্যের তপস্যা পণ্ড না করে, তাঁর সাধ্য-সাধনায় সহায়ক সেবিকার কাজে লিপ্ত হন, তাতে শুক্রের সাধনায় বাধাস্বরূপ না হয়ে বিজয়ের পথ আরো সুগম হয়। শুক্রাচার্যের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বর দেন-যুদ্ধে বিজয়ী হও। সে যুদ্ধে দেবতাদের পরাজয় ঘটে।
শেষ পর্যন্ত জয়ন্তীর সহযোগীতায় দৈত্যদের জয় হয়েছিল। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র যে জয়ের বিপক্ষে ছিলেন, দেবী জয়ন্তীর কৃপায় সে জয়কে তারা করতলগত করেছিল। কারোর সাধ্য ছিল না তাদের পরাজিত করে।
তারপর অবশ্য জয়ন্তীর ইচ্ছানুসারে শুক্রাচার্য তাঁকে পত্নী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দশ বত্সরকাল উভয়ে সুখে ও শান্তিতে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি দেবকুলে জন্মগ্রহণ করলেও দৈত্যের ঘরণী ছিলেন। এই সময় তাঁদের (জয়ন্তী + শুক্র) দেবযানী নামে এক কন্যা হয়।
দেবী জয়ন্তী সর্বত্র সর্বকর্মে বিজয়ী হয়েছেন। কারো কাছে তিনি পরাজয় স্বীকার করেননি। তাই তো তাঁর আর এক নাম অপরাজিতা। তিনি সর্বশক্তি-সমন্বিতা। জগতে তিনি বিভিন্ন রূপে পূজিতা হন।
পুরাণে আছে দেবী দুর্গার আট মূর্তি। এঁদের অষ্টনায়িকা বলা হয়। এই অষ্টনায়িকার মধ্যে দেবী জয়ন্তী হলেন চতুর্থ। আবার এই অষ্টনায়িকাকে অষ্টযোগিনীও বলা হয়। এঁরা হলেন যথাক্রমে-মঙ্গলা, বিজয়া, ভদ্রা, জয়ন্তী, অপরাজিতা, নন্দিনী, নারসিংহী, কৌমারী।
এছাড়াও দেবী দুর্গার অসংখ্য রূপ আছে। তাঁর কটা রূপই বা আমরা কল্পনায় আনতে পারি! তাঁর কটা নামই বা আমরা জানি! তিনি তো রূপে রূপে অরূপ হয়ে আছেন। সর্বভূতে সর্বরূপে সূক্ষ্মবীজাকারে তিনি ওতোপ্রোতভাবে অনুস্যুত হয়ে রয়েছেন। কখনো তিনি নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্ম। আবার কখনো সগুণ সাকার হয়ে সর্ববস্তুতে শক্তিরূপে বিরাজিতা। নেই তাঁর কোনো তুলনা। তিনি মা, সবার মা। সর্বশক্তিস্বরূপা। তাই শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে : ‘সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে / ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে নমোহস্তুতে।।’ (১১/২৪)
-হে দেবি! তুমি সকল কার্য ও কারণরূপিণী, সর্বেশ্বরী, সর্বশক্তিময়ী ও দুর্জ্ঞেয়া। তুমি আমাদের আপদ থেকে রক্ষা করো। হে দেবি, তোমাকে প্রণাম।

Print