Increase Reset Decrease

কপালিনী

কিংবদন্তী (২)

সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণু ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য গভীর তপস্যা করেছিলেন শ্বেতদ্বীপে। এখানে স্বয়ং স্রষ্টা ব্রহ্মাও কঠোর তপস্যা করেছিলেন সমস্ত কামনা-বাসনা জয় করার জন্য। সাধনকালে দুজনের সঙ্গে দুজনের দেখা হয়ে যায়। দুই তপস্বীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দর্শন দেন মহাদেব লিঙ্গশরীর ধারণ করে এবং এই সময় হঠাৎ একটা আকাশবাণী শোনা যায়, ‘যে বলতে পারবে এই শিবলিঙ্গের আদি-অন্ত সে-ই বড় তপস্বী ও জ্ঞানী বলে গণ্য হবে।’ দৈববাণী শুনে তপোভঙ্গ করে ব্রহ্মা উঠে আসেন। জ্ঞানী হওয়ার মানসে বুদ্ধি এঁটে কেতকী ফুল সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণুকে এসে বললেন, ‘এই কেতকী ফুল শিবলিঙ্গের মাথা থেকে এনেছি।’ অর্থাৎ ব্রহ্মা বিষ্ণুর কাছে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, তিনি শিবলিঙ্গের আদি-অন্ত জানেন। কাজেই তিনি-ই বড় তপস্বী ও জ্ঞানী। ব্রহ্মার এই মিথ্যা মন্তব্যকে সমর্থনও জানাল কেতকী ফুল। কিন্তু শিবের লিঙ্গদেহ স্বয়ম্ভু-অনাদি, অনন্ত। আদি-অন্তহীন শিবলিঙ্গের মাথা থেকে ফুল আনা সম্ভব নয়। ব্রহ্মার মিথ্যা উক্তিতে সাক্ষী দেওয়ার জন্য কেতকীকে বিষ্ণুর সামনে লিঙ্গদেহী মহাদেব আবির্ভূত হয়ে অভিশাপ দেন, ‘কোনো পূজায় কেতকী ফুল ব্যবহৃত হবে না।’ সেই থেকে কেতকী ফুল পূজায় নিষিদ্ধ হল। আর সেই সঙ্গে মিথ্যা-ভাষণের জন্য রুদ্রমূর্তিধারী মহাদেব ব্রহ্মার একটা মুণ্ড ছিঁড়ে নেন। ক্রুদ্ধ ব্রহ্মাও তখন বিপদে পড়ে শিবকে অভিশাপ দেন, ‘নরকপাল তোমার ভিক্ষার পাত্র হবে এবং তা নিয়ে জীবনভর ভিক্ষা করে খেতে হবে।’ ব্রহ্মার মুণ্ড ছিঁড়ে নেওয়ার জন্য ভিক্ষাজীবী শিবের ভিক্ষাপাত্র হল মুণ্ডুর অংশ কপাল। ভিখারী শিবও রেগে গিয়ে ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন, ‘ত্রিভুবনে কেউ কোনোদিন তোমায় পূজা করবে না।’ শিবের শাপে ব্রহ্মা পূজা আর পেলেন না কখনো। কিন্তু শ্মশানবাসী যোগীরাজ শিবকে সারাজীবন ভিক্ষা করতে হয়নি। অভিশপ্ত দেবাদিদেব মহাদেব শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুর ইচ্ছায় বারাণসীতে এসে শাপমুক্ত হন এবং এখানেই কপালীরূপী শিবের হাত থেকে নরকপালচ্যুত হয়।

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে শ্রীশ্রীদেবীকেই রুদ্রমূর্তি কপালিনী বলে আখ্যাত করা হয়েছে। সেখানেও সেই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কপাল ধারণ করেছিলেন দেবী। সেজন্য দেবীর অপর নাম হল কপালী বা কপালিনী। শাস্ত্রের এ তথ্যের অন্তরালে যে গভীর-তত্ত্ব আছে তা হল-দেবী তো জগজ্জননী। এই নিখিল বিশ্বকে তিনি পালন করেন। ভগবতী দেবীর হাতে যেন এই চরাচর বিশ্বের ভাগ্য বা কপাল নির্ভর করে। তিনিই সমস্ত জীবের ভাগ্যনিয়ন্তা বা কপাল নির্ধারিণী। এমনকি তিনি স্বয়ং জগত্স্র্রষ্টা ব্রহ্মারও কপাল ধারয়িত্রী। এখানেই দেবীর কপালিনী নামের সার্থকতা।

Print