দেবী দুর্গার রূপের বিবরণ

দেবী দুর্গার পূজা ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু জায়গাতেই হয়ে থাকে। তবে অঞ্চলভেদে দেবীর নামের এবং রূপের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই বৈচিত্র্যের বিস্তার প্রাচীনকাল থেকেই। শক্তিই সবকিছুর আধার। এই নিখিল বিশ্বচরাচরে তাঁর উপস্থিতি সর্বত্র। সর্বশক্তিময়ী মহামায়ার মহালীলায় সবকিছু গতিশীল, চঞ্চল। তিনিই সব কিছুর অধিশ্বরী। তাঁর অস্তিত্ব স্থলে জলে অন্তরীক্ষে, প্রতি অণু-পরমাণুতে। তাঁর উপাসনা সারা দেশজুড়ে। তবে এক এক জায়গায় তাঁর এক এক নাম, এক এক রূপ। যেমন বাংলাদেশে দুর্গা, উত্তর প্রদেশে বিন্ধ্যবাসিনী, গুজরাটে কল্যাণী, মহারাষ্ট্রে ভবানী, তামিলনাড়–তে মীনাক্ষী, কেরলে ভগবতী, কর্ণাটকে চামুণ্ডেশ্বরী।

দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত চামুণ্ডেশ্বরীর মূর্তি কল্পনা সম্পর্কে যে কাহিনী শোনা যায় তা প্রায় সবাইকারই জানা। তবুও অমৃত সমান কথা সংক্ষেপে বলি। ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর অমর। এই অমরত্বের জোরে মহিষাসুর নিজেকে স্বর্গ মর্ত্য পাতালের অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করে। দেবতা মুনিঋষিদের প্রতি অত্যাচার শুরু করে। স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা ও মুনিবরেরা বিষ্ণু ও শিবের শরণাপন্ন হয়ে সব কথা জানান। সব শুনে ক্রোধে বিষ্ণুর মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে ওঠে। দেবতাদের শরীর থেকে নির্গত সম্মিলিত তেজপুঞ্জ থেকে জন্ম হয় সুন্দরী শক্তিময়ী এক দেবীর। ইনিই দেবী দুর্গা। ইনিই মহাশক্তি। দেবতাদের দ্বারা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের প্রবল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের দশম দিনে পরাক্রমশালী মহিষাসুর বিরাটকায় মহিষের মূর্তি ধারণ করে দুর্গাকে আক্রমণ করে। দুর্গা ত্রিশূল বিদ্ধ করে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই অশুভর বিরুদ্ধে শুভর জয়কে কেন্দ্র করেই চামুণ্ডেশ্বরীর মূর্তি কল্পনা। মহা ধুমধাম করে মায়ের পূজা হয় নবরাত্রির দিন। নানান উত্সব-অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়। তবে অসুর বধের অনুষ্ঠানই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এক হাতে খড়্গ ও অন্য হাতে সাপ নিয়ে বিশাল মূর্তি স্থাপন করা আছে চামুণ্ডেশ্বরী মন্দিরের কাছে। শোনা যায় মহিষাসুর অর্থাৎ মহিষ থেকেই নাকি ‘মহীশূর’ নামের উত্পত্তি।

কুমারী ভগবতীর এক অসামান্য রূপের পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে কন্যাকুমারীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহে। শক্তিই সবকিছুর উত্স। এমনকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্মও এই শক্তি থেকে। এই শক্তিই প্রকৃতি। সবকিছু প্রজননের উত্পত্তিকেন্দ্র। সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে তাঁর স্থিতি। প্রকৃতি ছাড়া সব অচল। এমনকি প্রকৃতি ভিন্ন শিবশম্ভুও যেমন স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয় তেমনি প্রকৃতিও শিব ছাড়া অসম্পূর্ণ। এই উপলব্ধিই প্রতিষ্ঠিত ভগবতী কুমারীর ভাবকল্পে। এই প্রকৃতিই হলেন দেবী কন্যাকুমারী। বঙ্গোপসাগরে, ভারত মহাসাগর আর আরব সাগরের সঙ্গমে অবস্থিত কন্যাকুমারী। তিন সাগরের বালুর তিন রকম রঙ। সৈকতের এই বিচিত্র বালুর তেজস্ক্রিয় ধাতু থেকে এক ধরনের পারমাণবিক শক্তির উদ্ভব হয়। এই শক্তিতেই নিহিত রয়েছে সুপ্রীম পাওয়ারের অদৃশ্য অলৌকিক বিস্ময়কর উপস্থিতি। কাশী বিশ্বনাথের বাসস্থান বারাণসী। প্রকৃতির বাসস্থান কন্যাকুমারী, পুরনো নামে কেপকমোরিন। হিন্দুদের কাছে দুটি জায়গাই পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। হিন্দুশাস্ত্র মতে ওই দুই দেবতার দর্শন ও পূজায় ভক্তের তীর্থযাত্রার পুণ্য সঞ্চয় সফল হয়। নবরাত্রির দিন এই মন্দিরে দেবী অর্চনাকে কেন্দ্র করে নানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। উত্সবের অঙ্গ হিসেবে দেবী-অসুরের মধ্যে কৃত্রিম যুদ্ধ হয়। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘পরিভেত্তাই’। এই মন্দির অত্যন্ত প্রাচীন। উপনিষদে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বলরাম ও অর্জুন এই পবিত্র দেবী দর্শনে এসেছিলেন।

মাদ্রাজ শহর থেকে ত্রিশ মাইল দক্ষিণে সমুদ্রতীরবর্তী পাহাড়ের গায়ে মন্দির ও ভাস্কর্য পল্লব রাজাদের শিল্পগৌরবের সাক্ষ্য বহন করছে। এই স্থানটি ‘মমল্লপুরম’ বা ‘মহাবল্লিপুরম’ নামে পরিচিত।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত সময়সীমায় পল্লব রাজাদের ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকীর্তিগুলি রচিত হয়েছিল। পঞ্চপাণ্ডবের নামানুসারে রথমন্দির, শ্রীকৃষ্ণের গোদাহন, গঙ্গাবতরণের দৃশ্য, অর্জুনের প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি শিল্পকীর্তিগুলোর মধ্যে মহিষাসুরমর্দিনীর ভাস্কর্য কালজয়ী হয়ে আছে। রাজা নরসিং বর্মন মহামল্লের আমলে নির্মিত এই ক্ষোদিত মণ্ডপ ভাস্কর্য সুন্দর প্রাণময়। এখানে অষ্টভুজা সিংহ বাহিনীর বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গি। বিশালকায় গদাধারী মহিষাসুর আক্রমণে উদ্যত। দেবসেনা ও অসুরসেনার মূর্তিমালাও অপূর্ব গতিছন্দে মণ্ডিত। গোটা রচনায় যুদ্ধ উন্মাদনার আবহ ও গতিবেগ অতি সুন্দরভাবে সঞ্চারিত হয়েছে। শক্তি ও সুষমার কি অপূর্ব সমন্বয়। দেহ রূপায়ণে কি সহজ আবেগপূর্ণ লাবণ্যময় প্রকাশ!

Print