
কাহিনী
এক পুরাণে আছে দুর্গম বলে এক অসুরের হাত থেকে দেবতাদের রক্ষা করবার জন্য দেবী স্বয়ং বিন্ধ্যাচলে তার সঙ্গে সংগ্রাম করেন। দুর্ধর্ষ অসুর ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করে তাঁর কছে বর পেয়েছিল কোনো পুরুষের হাতে তার নিধন হবে না। সে ব্রহ্মার কাছে আরও বর পায় বেদকে সে নিজের অধিকারে আনতে পারবে। এই বর পাওয়ার ফলে বেদকে সে লুণ্ঠন করার জন্য স্বর্গে-মর্ত্যে বৈদিক যাগযজ্ঞ লুপ্ত হয়ে গেল। তার ফলে বৈদিক মন্ত্রে উচ্চারিত হোমের অগ্নিমুখে দেবতাদের হবিপানও বন্ধ হয়ে যাওয়ায তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞাগ্নি না জ্বলায় যজ্ঞধূমের অভাবে আকাশে মেঘের সঞ্চার বন্ধ হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে বৃষ্টি না হওয়ায় ধরিত্রী শুকিয়ে যেতে লাগল। শুকনো মাটিতে কোনো শাকসব্জি, ফসল আর জন্মাতে পারল না। চারিদিকে দুর্ভিক্ষের হাহাকার দেখা গেল। স্বর্গে ও মর্ত্যে দেবতা ও মানুষেরা জীবন রক্ষার চিন্তায় বিপন্ন হয়ে দেবী আদ্যাশক্তির শরণাপন্ন হলেন। প্রায় শতবর্ষের অনাবৃষ্টিতে যখন ধরাধাম শুকিয়ে যাবার উপক্রম তখন শিবের শরীর থেকে এক অযোনিজা অপরূপা দেবীমূর্তির আবির্ভাব হল। সন্তানের আকুল আর্তিতে প্রসন্না হয়ে দেবী ভগবতী রূপ ধারণ করে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হলেন। পদ্মাসীনা চতুর্ভুজা সেই দেবী অপূর্ব দেহকান্তির অধিকারিণী। তবে তাঁর সারা শরীরে একশটা চোখ ফুটে উঠল। তিনি-‘ততঃ শতেন নেত্রানাম্ নিরীক্ষিষ্যামি যন্মুনিন্/কীর্তযিষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীমিতি মাং ততঃ।’ সেই দেবী তাঁর শত চক্ষু দিয়ে আর্ত সন্তানদের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সেই শত চোখে স্নেহ-করুণার বারিধারা ঝরে পড়তে লাগল। সাত দিন ধরে অবিরল ধারায় সেই আঁখিবারি শুকনো মাটিকে ভিজিয়ে সরস করে দিল। সেই দেবীর নাম হল শতাক্ষী। দেবী শতাক্ষী এর পরে তাঁর চারটি হাতে ধারণ করলেন ধনুর্বাণ, পদ্ম ও দশ রকমের শাক-কন্দ ও ফলমূল। এই পদ্মবীজ জলের ধারাতে পড়ে পদ্মকানন সৃষ্টি হল। আর দেবীর হাতের নানা শাকসব্জি ফলমূল মাটিতে পড়ে সরস মাটিতে নতুন করে খাদ্যবস্তু সৃষ্টি করতে লাগল। জগতে প্রাণ ফিরে এল। শস্যসম্ভারে ধরিত্রী সজীব প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। এই দেবীর নাম হল শাকম্ভরী। ইনিই দুর্গম অসুরের প্রভাব থেকে বেদকে ফিরিয়ে আনলেন ও যুদ্ধে তাকে পরাজিত করলেন। তার ফলে ‘দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।’ দুর্গাদেবী এই নামে খ্যাত হলেন। দেবতারা নিশ্চিন্ত হয়ে ‘বজ্রপঞ্জর’ নামে একটি বিখ্যাত স্তোত্রে তাঁকে বন্দনা করলেন।
এছাড়া মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী ভগবতীর মহিষাসুরমর্দিনী ও শুম্ভনিশুম্ভঘাতিনী চরিত্র অতি অপূর্বভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। সেকথা পূর্বে বলা হয়েছে।
রামায়ণের যুগেও ঋষি বাল্মিকী রামায়ণে সূত্রাকারে রাবণ বধের পূর্বে রামচন্দ্রের দেবী আদ্যাশক্তির কাছে জয়লাভের জন্য শক্তি প্রার্থনার উল্লেখ আছে একটি মাত্র শ্লোকে। তবে অন্য রামায়ণে বিশেষ করে কৃত্তিবাসী ও তুলসী রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের দেবী দুর্গাকে অকাল বোধনের বিস্তৃত আলোচনা আছে। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, দেবী ভাগবতেও এই শ্রীরামকে রাবণবধে সাহায্য করার জন্য দেবতাদের ইচ্ছায় স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মার মর্ত্যে নেমে এসে বিল্ববৃক্ষতলে দেবী দুর্গার বোধনের কথা আছে। আর সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পূজার বিধানও দেওয়া আছে। ব্রহ্মার পূজায় প্রসন্ন হয়ে অত্যাচারী রাবণকে সবংশে নিধন করতে দেবী ভগবতী আদ্যাশক্তি শ্রীরামের বাণে অধিষ্ঠিতা হয়ে একে একে দুষ্কৃতীদের বধ করে সীতাকে ফিরিয়ে আনতে রামকে সাহায্য করেন। শাস্ত্রে তাই বলা হচ্ছে, ‘রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ অকালে ব্রহ্মণাবোধো দেব্যাস্তয়িকৃতঃ পুরা।’
আর সেই দুর্গাপূজার ধারা এই যুগেও অব্যাহত রয়েছে উত্তরবঙ্গের এক রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের পরিপূরক হিসাবে। কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ শারদীয়া দুর্গাপূজা। বিখ্যাত স্মৃতিকার রঘুনন্দন শিরোমণি তাঁর গ্রন্থে এই পূজার বিধিব্যবস্থা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই শারদীয়া দুর্গাপূজা ছাড়াও এই দেশে আরও একটি দুর্গাপূজা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। সেটি বসন্তকালীন দুর্গাপূজা। একে বলে বাসন্তী দুর্গাপূজা। চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত শরতের দুর্গাপূজার মতোই সবকিছু সেই পূজায় অনুষ্ঠিত হয়। তফাৎ শুধু এতে ‘বোধন’ নেই। কারণ এটি কালের পূজা। দেবতারা এই সময় জাগ্রত থাকেন, তাই বোধন অনুষ্ঠানের দরকার হয় না। এই পূজার প্রচলক চণ্ডীসপ্তশতী গ্রন্থের প্রধান দুই নায়ক রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য। এঁরা মেধস মুনির কাছে তিন রূপে দেবীর কৃপালাভের জন্য তপস্যা করে দেবীর দর্শন পান ও তাঁর ইচ্ছামতো গঙ্গাতীরে কৃত্বা মূর্তিং মহীময়িম মাটির মূর্তি তৈরি করে নিজের বুক চিরে রক্ত দিয়ে শাস্ত্রমতে দেবীর পূজা করেন ও তাঁর কৃপালাভ করেন। এই সুরথ রাজাদের পূজাই বাসন্তী পূজা। এইভাবে মর্ত্যওে দেবীর পূজার প্রচলন তাঁরা করেন।