দেবী দুর্গার রূপ বৈচিত্র্য

পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই গ্রহকে নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। এই অসীম কৌতুহল, অনন্ত বিস্ময় থেকে জন্ম হয় পৃথিবীদেবীর। প্রাক্ আর্য-সভ্যতার যুগেও এই কল্পনা সজীব ছিল। মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পায় আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেবীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান যে ঐ মূর্তিগুলো দেবীমূর্তি এবং পৃথিবীদেবী। মহাজাগতিক ক্রিয়াকলাপ এবং অদৃশ্য মহাশক্তির মহালীলার উপলব্ধি থেকে পৃথিবীকে দেবীরূপে কল্পনা করা হয়েছে; যার প্রকাশ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে, প্রতিটি অণু-পরমাণুতে, পরমা প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

ভারতীয় চেতনায় এই দেবী কল্পনা এক অনন্যসাধারণ উপলব্ধি। এই চেতনাকে অবলম্বন করে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি বহুদূর প্রসারিত হয়েছে। এই উপলব্ধির গভীর অন্তঃস্থল স্পর্শ করে আমাদের ধর্মবিশ্বাস পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে আদি অনন্তকাল থেকে।

অসংখ্য দেবীর মধ্যে সাধারণ মানসলোকে মহাশক্তি দেবী দুর্গার প্রভাব অপরিসীম। এই দুর্গা চিরজাগ্রত এক চেতনার আনন্দময় রূপ। দেবীরূপে পার্বতী উমার বর্ণনা পাওয়া যায় ঋক্বেদের দেবীসূক্তে। অনেক পণ্ডিতের ধারণা বৈদিক যজ্ঞআগ্নি থেকে পৌরাণিক দুর্গাদেবীর উত্পত্তি। কারণ অগ্নি শক্তি রূপিণী। তেজোময়ী। দুর্গাতে যে শক্তি, অগ্নিতেও সেই শক্তি। দুর্গা সর্ব দেবতার সম্মিলিত তেজ ও শক্তি, তাই দুর্গা অগ্নিস্বরূপা।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে উমার ব্যাখ্যা ভিন্নরূপ করা হয়েছে। উমাকে বলা হয়েছে ব্রহ্মদায়িনী অর্থাৎ দুর্গা দেবতাগণকে প্রথমে ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন। আবার হিমবৎ পর্বতকন্যা দুর্গা হৈমবতী নামেও প্রসিদ্ধা। রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যে উমার উল্লেখ আছে। তান্ত্রিক মতে কুমারী দেবীর প্রতীক। কামাখ্যা মন্দিরে এখনও কুমারী পূজার প্রচলন আছে।

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষকে কুমারী দ্বীপ বলা হতো। কিছু গবেষকের ধারণা এই নাম থেকেই দুর্গার কুমারী নামের উত্পত্তি। আসমুদ্র ভারতে দেবী দুর্গার বৈচিত্রপূর্ণ প্রকাশ যেমন ব্যাপক তেমনি বিস্তৃত। শৈলসূতা, কৈলাসবাসিনী, মন্দরবাসিনী, বিন্ধ্যবাসিনী, পার্বতীদেবী, উমা, সিংহবাহিনী এমন আরও কত নামে তাঁর পরিচয়। বৈদিক যুগের শেষভাগে দুর্গাকে ভবানী, অম্বিকা, ভদ্রকালী, গৌরী প্রভৃতি নামেও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন। বৈদিক সাহিত্যে যেমন দুর্গা প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে তেমনি পুরাণ থেকে জানা যায় দুর্গাপূজার নানা কথা।

দুর্গা যাকে দুঃখে জানা যায়। কিংবা যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট থেকে ত্রাণ করেন যিনি দৈত্যনাশসূচক, বিঘ্ননাশসূচক, পাপ, রোগ, ভয় থেকে মুক্ত করেন, শত্রুনাশ করেন, আপদ-বিপদে রক্ষা করেন এবং অন্যায় অসত্যকে হনন করেন বলেই ইনি দুর্গা। ইনিই শিবপত্নী, ইনিই পরমা প্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ। ইনিই মহাশক্তি, শত্রুবিনাশিনী মহামায়া।

স্বর্গরাজ্য থেকে মহি অসুর দ্বারা বিতাড়িত দেবগণ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়ে বললেন, আমরা আপনার শরণ গ্রহণ করলাম-আপনি সেই দুরাচার অসুর বধের কথা ভাবুন। এই কথা শুনে বিভিন্ন দেবগণের শরীর থেকে নির্গত বিশাল পর্বতের মতো একীভূত তেজপুঞ্জ হতে জ্যোতির্ময়ী পরমাসুন্দরী এক অপূর্ব নারীমূর্তির আবির্ভাব হয়। এই নয়নবিমোহন নারীই মহাদেবী মহিষাসুরমর্দিনী।

সত্যযুগে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দেবীর মূর্তি তৈরি করে তিন বছর ধরে আরাধনা করেছিলেন। ত্রেতাযুগে রাবণ বসন্তকালে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করেছিলেন। এটাই বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের জন্যে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শরত্কালে এই পূজা করেছিলেন বলে এটা শারদীয়া পূজা নামে খ্যাত ও বহুল প্রচলিত। কথিত আছে মা দুর্গা ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে বিশ্রাম শুরু করেন এবং আশ্বিন মাসের কৃষ্ণাষ্টমীতে বিশ্রাম ভঙ্গ করেন। রামচন্দ্র অকালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন বলে এই পূজাকে অকালবোধনও বলা হয়। চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী মধু ও কৈটভ নামে দুই পরাক্রমশালী অসুরের হাত থেকে দেবতাদের বাঁচাবার জন্যে ব্রহ্মা অসময়ে দেবীকে জাগরিত করেছিলেন। আবার ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ ও শ্রীবিদ্যার ললিতা অনুসারে কামদেবের ভস্ম থেকে তৈরি ভণ্ড নামে এক অসুরকে হত্যা করবার জন্যেই দেবীকে অসময়ে জাগানো হয়েছিল। দ্বাপরে গোপ কুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতি হিসেবে পাবার কামনায় অগ্রহায়ণ মাসে হেমন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন। মহাভারতেও যুধিষ্ঠির কর্তৃক দুর্গাস্তব এবং ভীমপর্বে যুদ্ধের প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুনের দুর্গাস্তবের কথা বর্ণিত আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেবতা মানুষ নির্বিশেষে কালে কালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছেন দুর্গতিনাশের জন্যে।

দশভুজার পুত্র-কন্যাদের পূজা করা হয় ভিন্ন ভিন্ন কারণে। বসন্ত পঞ্চমীর দিনে সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। ইনি মেধা ও বিদ্যার দেবী। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য, সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী। শক্তিমত্তা ও বীর্যবত্তার প্রতিমূর্তি কার্তিক। কার্তিকী সংক্রান্তির রাত্রে সাধারণত মহিলারা কার্তিকেয় ব্রত পালন ও পূজা করে থাকেন। ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থীতে বিনায়কের বিশেষ পূজার রীতি আছে যা গণেশ চতুর্থী নামে প্রসিদ্ধ। ইনি বিঘ্ননাশক ও সিদ্ধিদাতা। যে কোনো দেবতার পূজার আগে গণেশের পূজা প্রচলন আছে। যে কোনো শুভ কাজের আগেও গণপতিকে পূজা ও স্মরণ করা হয়।

Print