
স্থাপত্য শিল্পের মূল্য
গুপ্তযুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যকলার মূল্য অপরিসীম। মহীশূর রাজ্যের বিজাপুর জেলায় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি আইহোলীর দুর্গা মন্দিরটি স্থাপত্য নির্মাণ-কৌশলের দিক থেকে যেমন অপরূপ তেমনি দুর্গার মূর্তিটিও অপূর্ব। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে মধ্যভারতের উদয়গিরি থেকে যে প্রস্তরনির্মিত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির নিদর্শন পাওয়া গেছে তা অসাধারণ। দক্ষিণ ভারতে চিদাম্বরম মন্দিরের গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত নটরাজের মূর্তি পৃথিবী-বিখ্যাত। দ্বাদশ শতকে নির্মিত এই মন্দিরের পশ্চিম দিকের গোপুরমে আঠারভুজা দেবীর অসুর সংহাররত মূর্তিটি গতানুগতিকতা-বহির্ভূত। খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকে কেরল থেকে প্রাপ্ত তীরধনুক হাতে দণ্ডায়মান শান্ত সমাহিত দুর্গামূর্তি তেমন চোখে পড়ে না। এই ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যটি আছে দিল্লিতে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।
স্বাতন্ত্রের দিক থেকে অসমের কাহিলিপাড়ার বৃত্তাকার ব্রোঞ্জ মূর্তি উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। মহিষ ও মর্দিনীর কেবল মুখের অবতারণায় দুর্গা-অসুরের সংগ্রামকে বোঝান হয়েছে প্রতীকী দ্যোতনায়। শিল্পকর্মটি আনুমানিক একাদশ শতকের। চিরাচরিত ঐতিহ্যসম্পন্ন দেবীকল্পনা বহির্ভূত একটি শিল্প নিদর্শন রয়েছে মধ্যপ্রদেশের ভাদো অঞ্চলে গদারমল মন্দিরে। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই মূর্তি ভাব ও ভঙ্গি দুই দিক থেকেই একেবারে চিরাচরিত রীতি-পদ্ধতির বাইরে। সিংহের ওপর উপবিষ্ট দুর্গার পায়ে মল বা নূপুর জাতীয় পাদভরণ। চতুর্ভুজা দেবীর ডান দিকের এক হাতে ফুল। আর এক হাত ব্যস্ত কপালের প্রসাধনে। বাঁ দিকের এক হাতে দর্পণ, অন্য হাত কানের লতিতে। সম্ভবত কানে দুল পরছেন। কারণ অন্য কানে দুল ঝুলছে। প্রসন্নচিত্ত সৌম্যভাব এই মূর্তিকে শিল্পবেত্তারা ‘শৃঙ্গার দুর্গা’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁদের অনুমান মূর্তিটি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর।
ভারতীয় চিত্তকলায় অনুচিত্র এক অমূল্য সম্পদ, যার জগৎজোড়া খ্যাতি ‘ইন্ডিয়ান মিনিয়েচার পেইন্টিং’ নামে। আয়তনে ক্ষুদ্র বলে এইরকম নাম। এই ধারায় রাধাকৃষ্ণের মিলন-বিরহ, ঋতুর বিবর্তন, ভগবত পুরাণ, সাতসতী, রসিকপ্রিয়া, গীতগোবিন্দ প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে বর্ণোজ্জ্বল ছবি আঁকা হয়েছে। পাশাপাশি দেবী দুর্গা কিংবা উমা-মহেশ্বরের প্রসঙ্গ দুর্লক্ষ্য নয়। ১৬২৫ সালে আঁকা জনপ্রিয় মুঘল পদ্ধতির একটি অনুচিত্রে দেখা যাচ্ছে দ্রুতচারী অশ্বারূঢ়া দেবী গদাধরী অসুর নিধনে উদ্যত। অনুচিত্রের বিভিন্ন শৈলীতে এই প্রসঙ্গ আঁকা হয়েছে। আঠার শতকের ক্যাংড়া শিল্পরীতিতে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধরতা দেবীর ছবিটি অতুলনীয়। যুদ্ধরতা দুর্গা বাঘের পিঠে ধাবমান। অস্ত্রশস্ত্রে তিনি সুসজ্জিতা। অসুরদের মধ্যে কেউ বা ভূলন্ঠিত, কেউ বা আক্রমণ রচনায় উদ্যত।
শিল্পকলার নানা শাখা-প্রশাখায় দেবী দুর্গার বৈচিত্র্যবিস্তার সীমাহীন। অষ্টদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে সব দারু বিগ্রহ তৈরি হয়েছে বাংলায় তাতেও দুর্গা, ভবানী, কালী, চণ্ডী, সিংহবাহিনী প্রভৃতি মূর্তি রয়েছে। হাওড়ার আমতা থানার অন্তর্গত রসুলপুর গ্রামে পদ্মাসনে উপবিষ্ট (১৮৫৪) দারু তক্ষণ মূর্তিটি চমত্কার। এছাড়া চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত জয়নগরের চণ্ডীতলায় জয়চণ্ডী মূর্তি, গড়িয়া থানার মহামায়া মন্দিরের বিগ্রহ, মেদিনীপুর জেলার বিনপুর থানার রামগড় গ্রামের দেবী দুর্গা এবং বাংলার আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলার সূত্রধরদের মুন্সীয়ানার উজ্জ্বল পরিচয়। আজ বাংলার দারু ভাস্কর্য অবলুপ্তপ্রায়। এই অবস্থায় ওই সব কাঠের দেবদেবীর মূর্তি এখন বঙ্গ সংস্কৃতির অতীত গরিমার মূল্যবান সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। টেরাকোটা মন্দির ও বিগ্রহ রচনায় বাংলার গৌরব সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুরের মন্দির ও বিগ্রহ অতুলনীয়। এখানেও মন্দিরগাত্রে মহিষমর্দিনীর রূপ মহিমা বিধৃত হয়ে আছে। আঁটপুরের গ্রামে দুশো বছরের একটি প্রাচীন পোড়ামাটির অতি মনোরম দুর্গামূর্তি আছে। এ ছাড়াও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাংলার বহু জায়গাতেই টেরাকোটায় দশভুজার মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়।
বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আর এক আলোকোজ্জ্বল জগৎ পট-চিত্র। বীরভূম, বাঁকুড়া, তমলুক, মুর্শিদাবাদ, কালীঘাট, কাটোয়া প্রভৃতি অঞ্চলের পটচিত্র উত্কৃষ্ট মানের। পট সাধারণত দুই রকমের। জড়ানো বা গোটানো পট (স্ক্রল) এবং চৌকো আকৃতির পট। পটেও পটুয়ারা দেবদেবী ও তাঁদের নানান কাহিনী টকটকে গাঢ় রঙে দেশজ রঙ আর মন দিয়ে এঁকেছেন, যার সঙ্গে সাধারণ সমাজজীবনের যোগ ছিল একসময়ে নিবিড়। শ্রীগৌরাঙ্গলীলা, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদির সঙ্গে দুর্গা আর তাঁর স্বামী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকা হয়েছে পটচিত্রে।
মায়ের আকর্ণবিস্তীর্ণ নয়নবিমোহন সলমা-জরির সাজে সজ্জিত একচালা দুর্গা প্রতিমার চল বহুকাল থেকেই। আধুনিক শিল্পীদের হাতে সেই ঐতিহ্য ভেঙে দেবী দুর্গার রূপকল্পনা ও আঙ্গিকগত পরিবর্তন ঘটেছে। কারণ আধুনিক শিল্পীদের কাছে দুর্গা প্রতিমা নিছক প্রতিমা নয়। একটা আর্টও বটে। শিল্প নিয়ে ঈশ্বরকে রচনা ব্যক্তিক চেতনা ও উপলব্ধির রঙে রাঙিয়ে। অধিকাংশ মূর্তিকল্প আইকনকে অনুসরণ করে রচিত হলেও কেউ কেউ তাকে ভাঙছেনও। এই ঐতিহ্য পরিবর্তিত রূপনির্মাণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভক্তদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে না।