Increase Reset Decrease

দুর্গারূপ

দুর্গা নামটি নানাভাবে শাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে-‘দুস্তরঃ যঃ ভবঃ সংসারসাগর তত্র নৌঃ’। অর্থাৎ দুর্গম সংসাররূপ সাগরে তুমি নৌকাস্বরূপা, তুমি দুর্জ্ঞেয়া-দুরধিগম্যা-নির্লেপা। দেবী স্বয়ং জীবকে ভবসমুদ্র পার করবার জন্য নৌকা ও তার কর্ণধার স্বরূপিণী। তোমাকে সহজে জানা বোঝা যায় না-‘নিজে না জানালে পরে কে তোমাকে জানতে পারে?’ দুর্গে অর্থাৎ সংকটে, দুর্গম বিপদে তোমার শরণ নিলে বিপদমুক্ত হওয়া যায়। ‘দুর্গা দুর্গা বলে যেবা পথ চলে যায়। শূলহস্তে শূলপাণি রক্ষা করেন তায়।।’ ‘দুর্গেষু নিত্যং ভবসঙ্কটেষু দূরন্তচিন্তাহি-নিগীর্য্যমানান/শরণ্যহীনান্ শরণাগতার্ত্তি নিবারিণীত্বং পরিপহি দুর্গে।’ হে মাতঃ দুর্গে, আমরা সর্বদা দুর্নিবার সংসার সঙ্কটে পড়ে দুর্দান্ত চিন্তার গ্রাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের আর কে আশ্রয় আছে বলো? তুমিই তো মা শরণাগতের আর্তি ব্যাকুলতা দূর কর, তাই তোমার শরণাগত আমাদের তুমি রক্ষা করো, মা দুর্গে।-‘দুর্গায়ৈ দুর্গপারায়ৈ।’ দুর্গা দুষ্প্রাপ্যা, সহজে তাঁকে পাওয়া যায় না। যুগ যুগ ধরে তপস্যা করেও যাঁকে পাওয়া যায় না। তিনি কৃপাসুমুখী না হলে, ধরা না দিলে তাঁকে জানা যায় না। অধরা ভগবতী তিনি, ষড়ৈশ্বর্য্যশালিনী, ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিনী। ‘সর্বোপাস্যা সর্বমাতা শৈবীশক্তির্মহাদ্ভুতা। সর্ববুদ্ধিঅধিদেবীয়মন্তর্য্যামীস্বরূপিণী। দুর্গসঙ্কটহন্ত্রীতি দুর্গৈতি প্রথিতাভুবি।। বৈষ্ণবানাং শৈবানাম উপাস্যেয়ঞ্চ নিতশঃ। মূল প্রকৃতিরূপা সা সৃষ্টিস্থিত্যন্তকারিণী। এই অতি অদ্ভূত আদ্যাশক্তি শিবানী সকলের উপাস্যা, সকলের আদি জননী, অন্তর্যামিনীরূপে ইনি নিখিল জগতের বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। জীবের দুর্গম সংকট নাশ করেন বলে ইনি দুর্গা নামে বিখ্যাতা। সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারকারিণী এই মূল প্রকৃতিরূপা ভগবতী শৈব-বৈষ্ণব সকলের পূজনীয়া (দেবী ভাগবত)। দেবী পূরাণে বলা হয়েছে- ইন্দ্রাদি দেবতাগণের বিপদে স্মরণ মাত্র যিনি উপস্থিত হন তিনি দুর্গা। ‘স্মরণাৎ অভয়ে দুর্গে তাড়িতা রিপু সঙ্কটে। দেবাশক্রাদয়ো যস্মাৎ তেন দুর্গা প্রকীর্তিতা।’

দুর্গা শব্দটি জীবের ১১টি পাপ বা দুঃখ নাশ করে, তাই তিনি দুর্গা-‘দুর্গোদৈত্য মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি/শোকেদুঃখে চ নরকে যমদণ্ডে চ জন্মনি/মহাভয়ে অতিরোগে চাপ্যাশব্দ হন্তৃবাচকঃ/এতান্ হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্তিতাঃ। দুর্গাহসিভবসাগরনৌরসঙ্গা/দুর্গেষুদুর্গেশ্বরী-দেহরূপদুর্গরক্ষাকারিণী। দেবী দুর্গা সর্বস্বরূপা-ত্রিজগতই যাঁর স্বরূপ। ইনিই সোমপায়ী ও অসোমপায়ী দেবতা, ইনিই দেবযোনিস্বরূপা, ইনিই ত্রিগুণাত্মিকা, ইনিই ইন্দ্র ও মনুস্বরূপা, ইনিই গ্রহনক্ষত্র জ্যোতিঃ-স্বরূপা। দেবী উপনিষদে দেবীর এই সর্বব্যাপকত্ব বলা হয়েছে।

তিনি সর্বেশে-তিনি সমস্ত কার্যকারণের নিয়ন্ত্রী। নারায়ণ ব্রহ্মাকে বলছেন দেবী ভাগবতে, ‘সেই মহাশক্তি কর্তৃকই তুমি সৃষ্টিকর্তা তাঁর রাজসী শক্তিতে। তাঁর সাত্ত্বিকী জগত্পালনকারিণী শক্তিতে আমি পালন করি। আর তাঁর তামসী সংহরণকারিণী শক্তিতে মহাদেব সংহার করেন। তাঁর শক্তি বিরহিত হলে আমরা কোনো কার্যেই আর সমর্থ নই। সকলেই আমরা সেই সর্বেশ্বরীর অধীন-‘তদধীনা বয়ংসর্বে বর্ত্তাম সততং বিভো। তিনি সর্বশক্তিসমন্বিতে-চিৎ ও জড়ের মধ্যে সর্বভূতেই শক্তিরূপে তিনি বিরাজিতা। তাঁর শক্তিতেই সব কিছু স্পন্দনময় ও ক্রীয়াশিল। চৈতন্যময়ী তিনিই আদ্যাশক্তি।’ দেবী উপনিষদে দুর্গানাম বিষয়ে বলা হচ্ছে-‘যস্যাপরাতরং নাস্তি সৈষা দুর্গা প্রকীর্তিতা/দুর্গাৎ সংত্রায়তে যস্মাৎ দেবী দুর্গেতি কথ্যতে।’ যাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই, যিনি সকলকে দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন, তাঁকেই সকলে দুর্গা বলে।

মহাভারতে বিরাট পর্বের ষষ্ঠ অধ্যায় দ্বাদশ বর্ষ বনবাসের পর এক বত্সর অজ্ঞাতবাসকালে যখন বিরাট রাজার বাড়িতে পাণ্ডবেরা প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তখন অজ্ঞাতবাস যাতে নির্বিঘ্নে হয় সেই জন্য মুনি-ঋষিদের ইচ্ছা মতো যুধিষ্ঠির দেবী ভগবতীর স্তব করেছিলেন-‘দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গেত্বং তৎ ত্বং দুর্গে স্মৃতা জনৈঃ।’ এখানে দেবী অষ্টভুজা ইত্যাদি।

দ্বিতীয়বার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘শূচির্ভূত্বা মহাবাহো সংগ্রামাভিমুখেস্থিতঃ। পরাজয়ায় শত্র“নাং দুর্গাস্তোত্রং মুদীরয়।’ কৃষ্ণার্জুন দুজনে নতজানু হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্তব পাঠ করেছিলেন-‘হ্রীং নমস্তে সিদ্ধসেনানী আর্য্যমেন্দরবাসিনী/কুমারী কালি কাপালি কপিলে কৃষ্ণ পিঙ্গলে’ ইত্যাদি। অর্জুন এই স্তব করে যুদ্ধ আরম্ভ করেন।

এই দেবী দুর্গার আগম শাস্ত্রে বহু রকম মূর্তিভেদ আছে। তাঁদের আলাদা ধ্যানমন্ত্রও আছে। যেমন-নীলকণ্ঠী, ক্ষেমঙ্করী, হরসিদ্ধি, রুদ্রাংশ দুর্গা, বনদুর্গা, জয়দুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী দুর্গা, রিপুমোহিনী দুর্গা, মহিষমর্দিনী দুর্গা, শূলিনী দুর্গা ইত্যাদি। শারদাতিলক, তন্ত্রসার, বিষ্ণুধর্মোত্তর ইত্যাদি নানা তন্ত্রশাস্ত্রে এই সব দুর্গাদেবীর ধ্যান ও পূজাবিধি লেখা আছে।

Print